প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো মালদা শহরের রায়বাড়ির কার্তিক পুজো এখনও নিষ্ঠার সঙ্গে পূজিত হয়ে আসছে। এই পুজোকে ঘিরে যে মেলা বসত, করোনা আবহের কারণে সেই মেলা বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। কিন্তু রায়বাড়ির কার্তিক প্রতিমা দেখতে ভক্তদের কোনও কমতি নেই। কার্তিক প্রতিমার পাশাপাশি রয়েছে আরও ২৪টি দেবদেবীর মূর্তি। গত বুধবার রায়বাড়ির কার্তিক পুজো সম্পন্ন হলেও এই মুহূর্তে থাকে সাত দিন। তারপরে সাড়ম্বরে মহানন্দা নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়।
মালদা শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় অবস্থিত রায় পরিবারের বিশাল অট্টালিকা। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এই পুজো যদিও মনমোহন সাহার পুজো নামেই প্রসিদ্ধ। পারিবারিক পুজো হলেও, একরকম মিলন উৎসবে পরিণত হয় এই সময়টা। এবার করোনা আবহে অনেক কাটছাঁট করা হয়েছে। দেব সেনাপতির এক চালচিত্রে তিনি-সহ রয়েছেন ২৪ দেবদেবী। তাঁদের পুজো বাঁকাবিহারীর পুজোও বলে থাকেন অনেকে। বাঁকাবিহারীর এমন চালচিত্র দেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে দাবি পরিবারের।
রায়বাড়ির পুজো আবার বংশরক্ষার পুজোও বলে থাকেন অনেকে। কথিত আছে, দেব সেনাপতিকে তখনকার সাহা পরিবার বাঁকাবিহারী হিসেবে পুজো করতেন। বাঁকাবিহারীর কথা শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বৃত্তান্ত উল্লেখ আছে। শ্রীকৃষ্ণকে মামা কংসের হাত থেকে বাঁচাতে বিষ্ণুদেবের নির্দেশে দেব সেনাপতিকে মর্তে পাঠানো হয়। বাঁকাবিহারী নামে কারাগারের এক প্রহরীর দায়িত্বে ছিলেন। কংসের হাত থেকে তিনি যেহেতু শ্রীকৃষ্ণকে রক্ষা করেছিলেন অর্থাৎ বংশরক্ষা করেছিলেন, সেই অর্থে দেব সেনাপতির আরেক নাম বাঁকাবিহারী।
ফুলবাড়ির রায়বাড়ির পুজো বংশরক্ষার পুজো, সেই ভাবনা-চিন্তা থেকেই বংশের প্রথম সন্তান চালচিত্রের মধ্যে ঠাঁই হয়েছে দেব কিংবা দেবীর। এই ভাবে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২৪-এ। চালচিত্রটির মধ্যে নিজস্বতা আছে বলেই, কোথাও এহেন দেব সেনাপতির মূর্তি দেখা যায় না বলে দাবি পরিবারের। বাঁকাবিহারীর চালচিত্রে উপরের বেদিতে রয়েছেন ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন। মাঝের বেদিতে বাল্মিকী, গণেশ, জয়া, গঙ্গা, বিজয়া, শ্রীকৃষ্ণ ও বিশ্বামিত্রের মূর্তি। নীচের বেদিতে অন্নপূর্ণা ও সাবিত্রী। তারপর রাজ সেনাপতির বেশে দেব সেনাপতি। পাশে বসে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং সবার নীচে ষষ্ঠী দেবী। এবার অষ্টম পাল প্রতিমা তৈরি করেছেন। সাজশিল্পী রোহিণী মালাকার। এবং পুরোহিত পরম্পরাগত ভাবে কৃষ্ণদেব ঝা।
আরও পড়ুন একচিলতে চায়ের দোকান বুকে আগলে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে অবিচল ‘চায়েওয়ালি’ টুকটুকি
পরিবারের অন্যতম সদস্য রুনেন্দুকুমার রায় পুজোর ইতিহাস তুলে ধরেন। তাঁর মুখে শোনা গেল, অতি প্রাচীন এই পুজো। প্রায় ৩৫০ বছরের পুজো। তাঁরা রঙ্গ বণিক সম্প্রদায়ের। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর ব্যবসা ছিল তখন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির আমলে তাঁরা মালদার আম, রেশম অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায় রফতানি করতেন। আর সেখান থেকে মালদায় আসত চাল, চিনি, ডাল। ভাগলপুর থেকে আমদানি হত তেল, ঘি। ব্যবসার পাশাপাশি ছিল তাঁদের জমিদারিও।
তখন এই জেলায় উপজাতি সম্প্রদায়ের বাস। সংখ্যালঘু ছিলেন তাঁরা। মালদায় শ্রীচৈতন্যদেব আসার পর উপজাতির সংখ্যাও আরও কমতে থাকে। রুনেন্দুবাবু জানান, ‘বংশরক্ষা করাই তখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বংশরক্ষার তাগিদ থেকেই পূর্বপুরুষেরা বাঁকাবিহারীর পুজো শুরু করে বলে কথিত আছে। করোনা আবহে রাতের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। মেলাও বন্ধ রেখেছেন স্থানীয়রা। পুরো বাড়ি স্যানিটাইজ করা হয়েছে।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন