শহরের ব্যস্ত রাস্তার পাশে একচিলতে দোকান। সেখানে হরেক কিসিমের চীনে খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেন এক শতবর্ষ ছুঁই-ছুঁই অতিবৃদ্ধ চীনা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে থাকেন তিনি, বিক্রিবাটার তদারক করেন। ঝড়, বৃষ্টি, দাবদাহ, ধর্মঘট - যাই হোক না কেন, একটি দিনও কামাই হয় না কলকাতাকে ভালবেসে ফেলা প্রাচীন মানুষটির। টেরিটিবাজারে চীনে রেস্তোরাঁর মালিক ৯৮ বছর বয়সী কু শি ফং নিজেই যেন এক জীবন্ত ইতিহাস।
টেরিটিবাজার এলাকার ব্ল্যাকবার্ন রোডের ওই রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেই চোখে পড়বে প্রবীণ কু শি-কে। ছোট্টখাট্টো মানুষটি হয় চেয়ারে বসে একমনে খবরের কাগজ পড়ছেন, অথবা বয়সজনিত ক্লান্তিতে বুজে এসেছে চোখ, খানিকটা ঝিমিয়ে নিচ্ছেন। কখনও দেখা যাবে নাতি কু চি বা দোকানের কর্মচারীদের ডেকে অনুচ্চ স্বরে রেসিপি নিয়ে আলোচনা করছেন। কথায় কথায় জানালেন, তাঁরা আদতে চীনের ক্যান্টন প্রদেশের বাসিন্দা ছিলেন।
আরও পড়ুন: মমতা মেগাস্টার, আমি টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল ষ্টার: অকপট মদন মিত্র
বিশ শতকের প্রথম দশকের শেষদিকে কু শি-র বাবা সিনিয়র ফং দেশ ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। তারপর থেকে এই শহরেই রয়েছে ফং পরিবার। কু শি বলেন, "বাবা কেন ক্যান্টন ছেড়েছিলেন, ঠিক জানি না। তবে মায়ের কাছে যা শুনেছি তাতে মনে হয়, হয়তো কোনও পারিবারিক কারণ ছিল। সেই সময় ক্যান্টন ছিল শান্ত শহর। আমরা শহর থেকে মাইল কুড়ি দূরের এক মফস্বলে থাকতাম।" তাঁর কথায়, "কলকাতায় বহুদিন আগে থেকেই চীনারা থাকতেন। বিশেষত, দাঁতের ডাক্তারি আর জুতোর ব্যবসায় তাঁদের একাধিপত্য ছিল। সম্ভবত সেই কারণেই বাবা গঙ্গানদীর ধারের এই শহর বেছে নিয়েছিলেন।"
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কু শি-র স্মৃতি খানিকটা দু্র্বল হয়েছে। সব নাম মনে করতে পারেন না, ঘটনার পারম্পর্য গুলিয়ে যায়। স্মৃতি হাতড়ে তাও তিনি বলতে থাকেন, "আমার জন্ম ১৯২১ সালে। সেই সময় বাবা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। সম্ভবত চামড়ার ব্যবসা ছিল আমাদের, ঠিক মনে পড়ছে না। আমি কিছুদিন চীনা স্কুলে পড়েছি, ম্যান্ডারিন ছিল প্রধান ভাষা। তারপর ইংরেজি মাধ্যমে চলে গিয়েছিলাম। চাকরিবাকরি করার ইচ্ছে কোনওকালেই ছিল না। হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই ভাবতাম খাবারের ব্যবসা করব। অবশেষে ২৬ বছর বয়সে এই দোকানটা দিলাম। সেটা ১৯৪৭ সাল, ভারতের স্বাধীনতার বছর।" কু শি বলতে থাকেন, "সেই সময় শহরটা অনেক অন্যরকম ছিল। অনেক বেশি শান্ত, পরিচ্ছন্ন, ফাঁকা। বাঙালীরা এখনকার মতো এত বেশি চীনা খাবার খেতেন না, তাও আস্তে আস্তে দোকানটা দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ৭২ বছর কেটে গেছে। কত কী ঘটে গিয়েছে এই কলকাতায়! সবকিছু বদলে গিয়েছে। আমি আর আমার দোকান এই সবকিছুর সাক্ষী।"
আরও পড়ুন: হাওড়া ব্রিজ: পঁচাত্তর বছর বয়সী সর্বংসহ
কেমন ঘটনা সে সব? কয়েকটা কি ভাগ করে নেওয়া যায়? অতিবৃদ্ধ কু শি সর্ন্তপনে বলেন, দেশভাগের পরেই কলকাতায় চলে আসা উদ্বাস্তুর ঢল কীভাবে বদলে দিয়েছিল শহরের ছবি। বাড়িভাড়া আচমকা বাড়তে শুরু করেছিল। তারপর গোটা ৫০ আর ৬০-এর দশক জুড়ে চলেছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। টেরিটিবাজারে যদিও তার উত্তাপ ছিল ক্ষীণ। বৃদ্ধ জানান, সাবেক কালের পার্ক স্ট্রিট ছিল তাঁর প্রিয় গন্তব্য। সপ্তাহান্তের ডিনার করতে যেতেন একসময়। বয়সের ভারে কু শি-র কথা জড়িয়ে যায়। চুপ করে যান। তার মধ্যেই প্রশ্ন করা গেল, ১৯৬২ সালের ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের কথা কিছু মনে আছে কিনা। ঘোলাটে চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন কু শি। তারপর অস্পষ্ট, প্রায় বুজে আসা গলায় বলেন, "ব্যাড টাইম, ব্যাড মেমরি। আমাদের অনেকে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিল।"
কু শি-র সঙ্গে তাঁর দোকানে এখন বসেন নাতি কু চি। মধ্য চল্লিশের কু চি ম্যান্ডারিন জানেন, তবে খুব সড়গড় নন। পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি মাধ্যমে। তিনি বলেন, "এই দোকান আর দাদু যেন দুটো আলাদা অস্তিত্ব নন। দোকানটা দাদুর সত্তার অংশ হয়ে গিয়েছে। এই ৯৮ বছর বয়সেও উনি প্রতিদিন দুপুর ১২টায় দোকান খোলার সময় চলে আসেন। রাতে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত থাকেন। দোকানেই লাঞ্চ করেন। ওঁর কাছে আমরা হারিয়ে যাওয়া সময়টার ছোঁয়া পাই।"
এই শহরের প্রবীণতম দোকানদার কি কু শি-ই? কলকাতার ইতিহাসের গবেষক সত্যব্রত ভট্টাচার্য একরকম নিশ্চিত। তাঁর কথায়, "এই শহরে প্রবীণ মানুষদের সংখ্যা কমে আসছে। ৯৫ পেরোনো মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। তাঁদের কেউই এভাবে প্রতিদিন দোকানে বসেন না।" কলকাতার পুরোনো রাস্তা এবং দোকানের ইতিহাস আর্কাইভ করার কাজ করছেন সোমক দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, "বিশ্বের প্রবীণতম দোকানদার বলা হত ম্যানচেস্টারেরর বাসিন্দা জ্যাক ওয়াফিকে। তিনি একটানা ৭৮ বছর তাঁর হার্ডওয়ারের দোকান চালিয়ে ২০১২ সালে ১০৩ বছর বয়সে মারা যান। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, কু শি-ই এই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন দোকানদার।"