ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার! রাজ্যের একটা বড় অংশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবস্থাটা মোটের উপর এমনই বলে মনে করছেন বিশিষ্ট চিকিৎসকদেরই একাংশ। ফের একবার রাজ্যের গর্বের হাসপাতাল এসএসকেএমে চিকিৎসক নিগ্রহ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন তাঁরা। সরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর এই রোষের পিছনে রাজ্যকেই কাঠগড়ায় তুলে দুষছেন তাঁরা। একাধিক হাসপাতালে পর্যাপ্ত সংখ্যায় চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মী না থাকা এবং সার্বিকভাবে পরিকাঠামোগত খামতির জেরেই বারবার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই ধরনের হামলার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেছেন বিশিষ্ট চিকিৎসকদেরই একাংশ।
ফের চিকিৎসক নিগ্রহ। এবার ঘটনাস্থল এসএসকেএম। দুর্ঘটনায় জখম রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা, ভাঙচুর, হাতাহাতি। স্বজনের মৃত্যুতে এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার ইউনিটে কার্যত তাণ্ডব চালিয়েছেন পরিজনেরা। গত ৩০ নভেম্বর পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম ব্যান্ডেলের বাসিন্দা মহম্মদ আরমান নামে বছর ছাব্বিশের যুবককে আনা হয় এসএসকেএমে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রবিবার রাতে ওই যুবকের মৃত্যু হয়। অভিযোগ, এরপরেই চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগ তুলে হাসপাতালে চড়াও হন রোগীর পরিজনেরা। কয়েকজন চিকিৎসককে ধাক্কাধাকি করা হয়। এমনকী হাসাপাতালে ওই রাতে ভাঙচুরও চালায় রোগীর বেশ কয়েকজন আত্মীয়।
সরকারি হাসপাতালে এই তাণ্ডব নিয়ে সোমবারই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিজি-কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকার সমালোচনার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ''ঘটনার সময় ওখানে মাত্র দু'জন জুনিয়র ডাক্তার ছিলেন। তাঁদেরই হেনস্থা ও ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছে। কোনও সিনিয়র ডাক্তার তখন ছিলেন না।''
এদিকে, আবারও হাসপাতালে রোগীর পরিবারের হামলা-চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনায় সরকারকে দুষেই সুর চড়িয়েছেন বিশিষ্ট চিকিৎসকদের একাংশ। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের অভাব থেকে শুরু করে সরকারি হাসপাতালে সার্বিক পরিকাঠামোগত খামতির জেরেই বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তাঁরা। এরই পাশাপাশি মাসখানেক আগে সরকারি হাসপাতালের একাশের 'রেফার রোগ' নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর করা মন্তব্যেরও সমালোচনায় সরব হয়েছেন চিকিৎসকদের কেউ কেউ।
পিজি হাসপাতালে রবিবার রাতে ঘটনার সময়ে কোনও সিনিয়র ডাক্তার ছিলেন না বলে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর এই বক্তব্য প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক মানস গুমটা বলেন, ''সিনিয়র ডাক্তার মানে উনি কি বোঝাতে চাইছেন জানি না। হাসপাতালে এমার্জেন্সি বিভাগে অবশ্যই কোনও সিনিয়র চিকিৎসকক থাকেন। প্রফেসররা সাধারণভাবে অন কল থাকেন। এটাই নিয়ম, এটাই দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে। সব হাসপাতালেই সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তার থাকেন। যদিও কোথাও সিনিয়র রেসিডেন্ট না থাকেন তবে তার দায় সরকারের। অর্থাৎ সেখানে সিনিয়র ডক্তারদের পোস্টিং দেওয়া হয়নি।''
আরও পড়ুন- টানা ঘেরাও অধ্যক্ষ-অধ্যাপকরা, মাত্রাছাড়া অশান্তি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে, দায়ের মামলা
এরই পাশাপাশি চিকিৎসক গুমটা আরও বলেন, ''রেফারের দায়ও চিকিৎসকদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত চিকিৎসক, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো দেবেন না, আবার রেফার করলেই তার দায় চিকিৎসকদের ঘাড়েই চাপাবেন? এটা তো ভয়ঙ্করভাবে মানুষকে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়ার সামিল।''
সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, ''রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে এই ধরনের হামলার একটা বড় কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব থাকা। হাসপাতালগুলিতে সার্বিক পরিকাঠামোগত অভাব রয়েছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে রোগীদের চাপ সামাল দেওয়াই যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত সংখ্যায় চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে অন্য স্বাস্থ্যকর্মী নেই। সেটাই এই ধরনের হামলার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় কারণ।''
অন্যদিকে, বিশিষ্ট চিকিৎসক পূর্ণব্রত গুন বলেন, ''কেবলমাত্র পুলিশ দিয়ে এই ধরনের হামলা আটকানো যাবে না। সরকার বারবার ঘোষণা করছে সরকারি হাসপাতালে সব পরিষেবা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। রোগীও সেটা ভেবেই আসছেন। অনেক হাসপাতালে যে মেশিন আছে তা চালানোরও লোক থাকে না। পর্যাপ্ত সংখ্যায় চিকিৎসক, মেডিক্যাল স্টাফ নেই। নিয়োগও বন্ধ রয়েছে। যত ডাক্তার আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে না তুললে এই ধরনের ঘটনা আটকানো যাবে না।''