ঘর হোক বা রাস্তা, আবর্জনা সাফ করতে ঝাঁটাই ভরসা। তবুও এই ঝাঁটার সঙ্গে নানা লোকাচার যেমন জড়িয়ে রয়েছে তেমনই জড়িয়ে রয়েছে রাজনীতিও। তাই ঝাঁটাই হয়ে গিয়েছে আম আদমি পার্টির প্রতীক। এহেন ঝাঁটাই এখন আবার বাংলার যুবকদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের দিশা দেখাচ্ছে। না, এটা নিছক কথার কথা নয়। বাস্তবেই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আকারে 'ঝাঁটা' তৈরি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের পালিশ গ্রামের বাসিন্দা শেখ আব্দুস সামাদ। তবে অবশ্য শুধু 'নারকেল কাঠির' ঝাঁটা নয়, ‘নেপা কাঠি’ দিয়েও তিনি ঝাঁটা তৈরি করছেন।
কৃষি নির্ভর জেলা হিসেবেই রাজ্যে পরিচিত পূর্ব বর্ধমান। 'শস্যগোলা' হিসেবেও রাজ্যে এই জেলার পরিচিতি রয়েছে। কৃষি বিনা অন্য কোনও বিকল্প কর্ম পথে রোজগারের ভাবনাই যেন ভাবতে পারেন না এই জেলার বাসিন্দারা। এরকমই এক জেলার বাসিন্দা হয়েও আব্দুস সামাদ এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পেরেছেন। শুধু চাষ নয়, স্বল্প পুঁজি নিয়ে গোছা গোছা ঝাঁটা তৈরি ও তা বাজারে বিক্রি করেও যে রোজগার করা যায় সেই দিশাই তিনি দেখাতে পেরেছেন। ঝাঁটা তৈরি করে সামাদ এখন নিজে যেমন ভালো উপার্জন করছেন, তেমনই তাঁর ঝাঁটা তৈরির কাজে শ্রম দিয়ে আরও অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বছর ৭২-এর আব্দুস সামাদ বলেন, 'চাষের জমি আমাদের নেই বললেই চলে। তাই চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। একটা সময় ছিল, যখন অভাব অনটনই ছিল আমার পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী। দু'টো পয়সা রোজগারের জন্যে তখন আমি বিভিন্ন ব্যক্তির দেওয়া নারকেল কাঠি দিয়ে ঝাঁটা বানিয়ে দিতাম। আমার ঝাঁটা তৈরি ভালো হত বলে খুশি হয়ে তারা একটা ঝাঁটা তৈরির জন্য আমায় ১০ টাকা দিতেন।'
সামাদ জানান, এভাবেই লোকের ঝাঁটা তৈরি করে দিয়ে তাঁর দিন চলছিল। তার পর একদিন তিনি ঠিক করে ফেলেন, আর লোকের ফরমাশ মেনে ঝাঁটা তৈরি নয়, এবার তিনি ঝাঁটা তৈরিকেই জীবিকা হিসাবে কাজে লাগাবেন। সেই মত প্রায় ৪০-৪৫ বছর আগে মাত্র ৩০০ টাকা পুঁজি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নারকেল কাঠি কিনে তিনি নিজের বাড়িতেই বেশ কিছু করে ঝাঁটা তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। এখনও সেটাই করছেন। তবে এখন একপ্রকার ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের আকারে ঝাঁটা তৈরি করে তা বাজারজাত করছেন বলে আব্দুস সামাদ জানিয়েছেন।
বাড়ির ফাঁকা জায়গাতে বসে তিন শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে আব্দুস সামাদ এবং তাঁর বড় ছেলে শেখ কামরুজ্জামান ওরফে সাগর প্রতিদিন গোছা গোছা ঝাঁটা তৈরি করেন। সাগরের ভাই শেখ সাহেব
সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ করেন। সাগরের কথায়, 'বছরের আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ন মাসে ঝাঁটার চাহিদা বেশি থাকে। এছাড়াও আউস, আমন ও বোরো ধান ঝাড়াইয়ের কাজ শুরু হলে ঝাঁটার চাহিদা বাড়ে। সেটা মাথায় রেখে তখন প্রতিদিন ৬০০ ঝাঁটা তৈরি করা হয়। বাকি বছরের অন্যান্য সময়ে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ ঝাঁটা তৈরি হয়।
তিনি আরও জানান, নারকেল কাঠি দিয়েই তাঁরা প্রথম থেকে ঝাঁটা তৈরি করছেন। তবে এ বছর নারকেল কাঠির পাশাপাশি 'নেপা কাঠি' দিয়েও ঝাঁটা তৈরি করেছেন তাঁরা। সাগরের দাবি, 'দাম একটু বেশি হলেও নেপা কাঠি দিয়ে তৈরি ঝাঁটা খরিদ্দারদের কাছে যথেষ্টই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।' তাঁদের তৈরি ঝাঁটার চাহিদা এখন মঙ্গলকোট ও শহর বর্ধমানের বাজার ছাড়াও প্রতিবেশী জেলা মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূমের পাশাপাশি হাওড়ার বাজারেও বেড়েছে। তাই ওই সব জেলাতেও এখন ঝাঁটা সরবরাহ করছেন তাঁরা।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, সাগর ও তাঁর বাবার ঝাঁটা তৈরির কারবার দেখে ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকরাও প্রশংসা করেছেন। ব্লক প্রশাসন সহযোগিতা করায় সম্প্রতি সাগর ৪ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক লোন পেয়েছেন। সাগর জানান, ব্যাঙ্ক লোনের টাকায় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকার ঝাঁটার কাঠি কিনে বাড়িতে মজুত করেছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন- ঈশ্বর নয়, তিলোত্তমার এই কারখানায় বিনামূল্যে অঙ্গদান করেন ‘মহামানব’রা
নারকেল কাঠি দিয়ে যে ঝাঁটা তৈরি হয় সেটা সবাই জানেন। কিন্তু 'নেপা কাঠি'র বিষয়টা অনেকের কাছেই অজানা। 'নেপা কাঠি' তাহলে কী ? এই প্রশ্নের উত্তরে আব্দুস সামাদ জানান, কয়েক মাস আগে হলদিয়ার এক মহাজনের কাছ থেকে তিনি প্রচুর নেপা কাঠি কেনেন। ওই মহাজনই তাঁকে জানিয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার কোনও গাছের পাতা থেকে মেলে এই 'নেপা কাঠি'। ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজে লোড হয়ে দক্ষিণ ভারত হয়ে 'নেপা কাঠি' পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দরে আসে। সেখান থেকেই মহাজনরা 'নেপা কাঠি' সংগ্রহ করেন।
'নেপা কাঠি'র সঙ্গে নারকেল কাঠির তফাৎ কী? উত্তরে আব্দুস সামাদ বলেন, “নারকেল কাঠির থেকে নেপা কাঠি বেশি লম্বা। তাই নেপা কাঠি দিয়ে তৈরি ঝাঁটা আকারে একটু বড় হয় বলে খরিদ্দারদের নজর কাড়ে। এছাড়াও যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করলেও নারকেল কাঠির ঝাঁটার চাইতে নেপা কাঠি দিয়ে তৈরি ঝাঁটার কাঠির ক্ষয় কম হয়। সেই কারণে দাম বেশি হলেও খরিদ্দাররা নেপা কাঠি দিয়ে তৈরি ঝাঁটা কিনতে দ্বিধা করছেন না।
আরও পড়ুন- কলকাতায় ফের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উদ্ধার, নিউটাউনের আবাসন থেকে ইডি-র জালে ২
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার মঙ্গলকোটের পালিশ গ্রামেরই
বাসিন্দা। তিনি বলেন, 'আব্দুস সামাদকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি। বেশ কয়েক বছর আগে একপ্রকার শূন্য হাতেই তিনি ছোট আকারে ঝাঁটা তৈরির কারবার শুরু করেছিলেন। এখনও তিনি ঝাঁটাকে আঁকড়েই রয়েছেন। তবে এখন তার ঝাঁটা তৈরির কারবারের অনেক শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। গ্রামের শ্রমিকরাও সামাদের সঙ্গে কাজ করছেন। প্রশাসনও সামাদের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।'