Advertisment

Topor: বরের মাথার 'টোপর' আর তার কারিগররা…

Topor: টোপর ছাড়া হিন্দু বিয়ে যেন অকল্পনীয়। শোলা শিল্প বহু প্রাচীন লোকশিল্প। বাংলার বিভিন্ন জেলায় শোলা পাওয়া যেত। বর্ষার শেষ হতেই বাজার জুড়ে থাকত জলাশয়ে জন্মানো শোলা। এই শোলা কিনে নিয়ে যেতেন গ্রামীণ শোলা শিল্পীরা। তার পরে সেটি দিয়ে তৈরি হত নানা উপকরণ। পরিবেশের ভারসম্য নষ্ট হয়ে যাওয়াতে এই শোলা পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে শোলা আমদানি করা হত।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
About the groom's topor and his craftsmen

Topor: হাবড়ার অশোকনগরে চলছে টোপর তৈরির কাজ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

Topor For Bengali Groom: সন্ধ্যার আকাশের রঙ বালুচরির মতো, বাতাসে সুখাদ্যের সুঘ্রাণ। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে বিসমিল্লার সানাই… গোধূলি লগ্ন। রজনীগন্ধার ফুলে ম ম। বিকেলের সূর্য অস্ত গিয়েছে। আলো ঝলমলে সন্ধ্যায় আমন্ত্রিতরা সবাই আসতে শুরু করেছে একে একে। সুশোভন সাজে আগত নিমন্ত্রিতদের সানন্দ আপ্যায়ন, সৌজন্য বিনিময়, সকলকে সন্তুষ্ট করতে আমন্ত্রণকর্তা নিজেই করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাজানো হয়েছে বিয়ের বেদি। টোপর মাথায় বর।

Advertisment

শোলার কারুকার্যের এই টোপর বেশ চোখ টানছে সকলের। সুসজ্জিত ছাদনা তলায় জোড়া পানে মুখ ঢেকে একটু পরেই হাজির হবে কনে। তারপর… শ্রী শ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ – কল্যাণীয়া ওমুকের সঙ্গে কল্যাণীয় তমুকের শুভবিবাহ সম্পন্ন হইল। বাঙালির এই বিয়ের দৃশ্যের সঙ্গেই সকলেই পরিচিত। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির আচার নিয়ম নীতির সঙ্গে যেন লুকিয়ে আছে একেকটা গল্প। যেমন গল্প লুকিয়ে আছে বরের মাথার টোপরের সঙ্গে।

publive-image
তৈরি হচ্ছে টোপর- এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

কথিত আছে, শিব হিমালয়কন্যা পার্বতীকে বিয়ে করার সময় শ্বেত মুকুট পরার ইচ্ছা পোষণ করেন। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা তখন মুকুট তৈরির উপাদানের কথা ভাবতেই শিবের ইচ্ছায় জলাশয়ে একধরনের উদ্ভিদ জন্মে, সেটাই শোলাগাছ। কিন্তু বিশ্বকর্মা শুধু পাথর বা কাঠের মতো শক্ত দ্রব্যে দিয়ে কাজ করতে পারদর্শী, শোলার মতো নরম জিনিসে নয়। তখন শিবের ইচ্ছায় জলাশয়ে এক সুকুমার যুবকের আবির্ভাব ঘটে, যাকে বলা হয় মালাকার। শোলাশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা এখন এই নামেই পরিচিত এবং হিন্দু সমাজভুক্ত।

publive-image
পরিশ্রমের ন্যায্য পারিশ্রমিকটুকু তুলতেই হিমশিম দশা হয়, এমনই বলছেন টোপর কারিগররা। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

এই মালাকার সম্প্রদায়ের মানুষরাই প্রথম থেকে শোলা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। মালাকারেরা বংশানুক্রমে শোলা দিয়ে বৈচিত্র্যময় টোপর, দেবদেবীর অলংকার, চালচিত্র, পূজামন্ডপের অঙ্গসজ্জার দ্রব্যাদি, মালা, গয়না, খেলনা ও গৃহসজ্জার নানা উপকরণ তৈরি করে। সূত্রধর ও কর্মকারেরা পুজো করেন বিশ্বকর্মার এবং মালাকারেরা শিবের উপাসক। এদের ধারণা, শিবের ইচ্ছায় তাদের আবির্ভাব ঘটেছে, তাই তিনিই তাদের উপাস্য।

আরও পড়ুন- Raiganj-TMC: এযেন স্বপ্ন সত্যি হল! বঙ্গে তৃণমূলের নতুন কীর্তি! এই প্রথম রায়গঞ্জে ‘ইতিহাস’ তৃণমূলের

publive-image
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

হাবড়ার অশোকনগরে এই মালাকারদের বাস। এখানে প্রতিটি ঘরে ঘরে হয় শোলার কাজ। বারান্দা ও উঠানে বসে ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ শোলা কাটছে, কেউ রং করছে, কেউবা মালা গাঁথছে। দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় টোপর। উত্তরাধিকার সূত্রে এরাই শোলার কাজ করে যাচ্ছেন বহু যুগ ধরে। এই মালাকাররাই শোলা দিয়ে গাঁথেন মালা, তৈরি করেন পুজোর-ঘরসজ্জার ফুল, পাখি, খেলনা, হাতপাখা, অলঙ্কার, পশুপাখিসহ আরও নানাকিছু। এইভাবে একটি বিশেষ সম্প্রদায় শোলানির্ভর হয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন। মালাকার সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই মূলত পূর্ববঙ্গের মানুষ। দেশভাগ কিংবা তারও আগে এই বঙ্গে এসে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেন। কথা হচ্ছিল শোলা শিল্পী বিদ্যুৎ বৈরাগীর সঙ্গে। তিনি অনেক ছোট বয়স থেকে এ শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িত।

publive-image
প্রাচীন এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি সাহায্যের দাবি করেছেন টোপর কারিগররা। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

"আমার বাপ ঠাকুরদার এই পেশা। আমিও তাই পেশাকেই বেঁছে নিয়েছি। একশ বছরের বেশী সময় ধরে এই কাজ চলে আসছে। ছোট বেলায় বাবার কাছে কাজ শিখে এই পেশায় চলে এসেছি। অশোকনগরের কালো বাড়ি এলাকায় প্রত্যেক ঘরে ঘরে আমার মতন আরও অনেক শোলা শিল্পীরা রয়েছে। আমাদের এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শোলার টোপর, শোলার বিভিন্ন জিনিস রপ্তানি হয়। কিন্তু শিল্পী হিসেবে সরকারি কোন সুযোগ সুবিধায় আমাদের নেই। একটা টোপর তৈরি করে আমরা বিক্রি করি মাত্র দুশ থেকে আড়াইশ টাকায়। বাজারে সেই টোপর বিক্রি হয় হাজার টাকার ওপরে। আমাদের প্রচার কিংবা রোজগার দুটোর কোনটায় হয় না। আমাদের মতন শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সরকারকে এগিয়ে আসা উচিৎ।" আক্ষেপের সুরে বলছিলেন বিদ্যুৎ।

আরও পড়ুন- WB By Election Results 2024: মতুয়া সমাজেও ‘ব্রাত্য’ হতে শুরু করল BJP? উপনির্বাচনের ফলে উঠল প্রশ্ন

টোপর ছাড়া হিন্দু বিয়ে যেন অকল্পনীয়। শোলা শিল্প বহু প্রাচীন লোকশিল্প। বাংলার বিভিন্ন জেলায় শোলা পাওয়া যেত। বর্ষার শেষ হতেই বাজার জুড়ে থাকত জলাশয়ে জন্মানো শোলা। এই শোলা কিনে নিয়ে যেতেন গ্রামীণ শোলা শিল্পীরা। তার পরে সেটি দিয়ে তৈরি হত নানা উপকরণ। পরিবেশের ভারসম্য নষ্ট হয়ে যাওয়াতে এই শোলা পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে শোলা আমদানি করা হত। শোলা আমদানিতে কড়াকড়ি শুরু হলে শোলার কাজ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিল শিল্পীদের। যদিও কিছু জায়গায় ইদানীং শোলার চাষ শুরু হওয়াতে এই সমস্যা কিছুটা হলেও কমেছে বলে জানিয়েছেন শিল্পীরা।

publive-image
চলছে টোপর তৈরির কাজ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

শোলা আসলে একটি কান্ডসর্বস্ব গাছ। কান্ডের বাইরের আবরণটা মেটে রঙের, কিন্তু ভেতরটা সাদা। শোলাগাছ সাধারণত ৫-৬ ফুট লম্বা হয় এবং কান্ডের ব্যাস হয় দুই থেকে তিন ইঞ্চি। দুই ধরণের শোলা জন্মায় একটি কাঠ শোলা ও অপরটি ভাট শোলা। কাঠশোলা অপেক্ষাকৃত শক্ত, কিন্তু ভাটশোলা হালকা ও নরম। মূলত বর্ষাকালে এই শোলা জলাশয় থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো শুকিয়ে তারপর কাজে লাগে। কিন্তু এখন গ্রামের অধিকাংশ জলাশয়ই আর আগের মতো জল নেই, ফলে সেই জলাশয়গুলোয় শোলাও উৎপন্ন হয় না তেমন।

আরও পড়ুন- Koilaghat Building: কলকাতার বুকে এক স্বর্ণালী ইতিহাস! রেলের কয়লাঘাটা ভবন নিয়ে এই তথ্য অবাক করবেই!

গত তিরিশ বছর ধরে শোলার কাজের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী অরিজিত দে। অশোকনগরে অন্যতম নামকরা শোলা শিল্পী। দশ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। পড়াশুনা শেষ করে ১৯৯৫ সাল থেকে শোলার কাজকেই নিজের রুটি রুজি হিসেবে বেঁছে নেন। তিনি বলছিলেন, "পড়াশুনা শেষ করে কাজের যা অবস্থা দেখলাম তাতে শোলার কাজকে অনেক সহজ বলে মনে হল। আমার দুই দাদা প্রথম এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাঁদের হাত ধরেই এই পেশায় চলে এলাম। অশোকনগরে শোলার কাজের সৃষ্টিকর্তা চিত্ত মালাকার। ওনার ঘরানাতেই ওনার কাজ শিখি আমরা। শোলার কাজের শোলাটাই আসল। এখন এই শোলা পাওয়াটাই মুশকিল হয়ে পড়ছে। বর্তমানে জয়নগর মথুরাপুর থেকে শোলা এনে কাজ করতে হয়। আগামীতে তাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে! আজ থেকে দশ পনের বছর আগেও দশ হাজার টাকাতে এক ম্যাটাডোর শোলা পাওয়া যেত, এখন এক ভ্যানও পাওয়া যায় না। এর সাথে কাঁচামালের যা দাম বেড়েছে এতে অনেক কারখানা প্রায় বন্ধের মুখে। সেই মতন আমরা টোপরের দাম বাড়াতে পারছি না। আমাদের যে কি হবে ঈশ্বর জানেন!"

আরও পড়ুন- WB By Election Results: বিধানসভা থেকে লোকসভার ‘দগদগে ক্ষত’, উপনির্বাচনে ৩ কেন্দ্রে BJP বধে জমাটি ‘ম্যাজিক’ তৃণমূলের!

publive-image
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী শোলাশিল্প। এই শোলা শিল্প প্রাচীন বঙ্গসংস্কৃতির এক অনন্য ধারা। এক সময় আমাদের এই বঙ্গদেশের প্রায় সব রকম আচার অনুষ্ঠানেই শোলার ব্যবহার ছিল। সারা বছর শিল্পীরা ব্যস্ত থাকতেন তাঁদের এই শোলা শিল্পের কাজে। এই কাজ করেই একেকটি পরিবার চলত অনায়াসে। পুরাণে বলা হয়েছে শোলার তৈরি সাদা টোপর সৌভাগ্য এনে দেয়। তার জন্যেই সাধারণত কনের বাড়ি থেকে টোপর পাঠানো হয় বরের বাড়িতে। এ যেন আজ উলটো পুরাণ হয়ে গিয়েছে, যে শোলার জন্মই হয়েছিল এই সৌভাগ্যের জন্যে তার ভাগ্যেই আজ দুর্ভাগ্যে পরিণত হচ্ছে।

Groom West Bengal Topor
Advertisment