Advertisment

লড়াকু বাবার মৃত্যু, শেষমেষ জেলমুক্তি, ভিনরাজ্য থেকে বাংলার পথে একরত্তি-সহ বাঙালি দম্পতি

পেটের জ্বালা ঘুচোতে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরু, সেখানেই ঘটে বিপর্যয়।

author-image
Chinmoy Bhattacharjee
New Update
Burdwan_Family

পলাশ ও শুক্লা অধিকারী

শ্রমিকের কাজ করতে বেঙ্গালুরু গিয়ে 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী' অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার ১০ মাস বাদে জেল থেকে মুক্তি পেলেন এই বাংলার এক দম্পতি। মা শুক্লা অধিকারী ও বাবা পলাশ অধিকারীর সঙ্গে জেলেই দিন কাটছিল তাঁদের শিশু পুত্র আদিরের। আর দু’এক দিনের মধ্যে দম্পতি পলাশ ও শুক্লা তাঁদের শিশুপুত্রকে নিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার জৌগ্রাম পঞ্চায়েতের তেলে গ্রামে ফিরবেন। বাড়িতে ফিরে তাঁরা পরিবারের সবার দেখা পাবে। কিন্তু, পাবে না

Advertisment

শুধু বাবা পঙ্কজ অধিকারীর দেখা। কারণ ছেলে, বৌমা ও নাতিকে বেঙ্গালুরু জেল থেকে মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াই গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পঙ্কজবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাস দুই আগে মারা যান। পলাশ বাড়ি ফিরেই সম্পন্ন করবে তাঁর প্রয়াত পিতার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম। তাই এখন ছেলে পলাশের জন্য পথ চেয়ে বসে আছেন তাঁর মা। বসে আছেন বোনেরাও।

জৌগ্রামের তেলে গ্রামে রয়েছে পলাশদের টিনের চালার দু’কুঠুরি ভাঙাচোরা বাড়ি। ওই বাড়ি দেখলে যে কেউ বুঝে যাবেন দারিদ্রতাই অধিকারী পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী। পলাশদের মতই তাঁদের প্রতিবেশীরাও অত্যন্ত দরিদ্র। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুই শুধুমাত্র তাঁদের সম্বল। বেশিরভাগই দিনমজুরির কাজ করে অন্নের সংস্থান করেন। বাকিদের কেউ বালাপোশ তৈরি, আবার কেউ বিড়ি বাঁধার কাজ করে উপার্জন করেন।

এমনই এক গ্রামের ছেলে পলাশ রোজগারের আশায় স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গত বছরের জুন মাসে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরু। কিন্তু, উপার্জন করা তো দূরের কথা। উলটে সেখানে তাঁদের পরিণতি হয় ভয়ংকর। পলাশ অধিকারীর আত্মীয় পিন্টু হাওলাদার বলেন, 'শ্রমিকের কাজ করে জন্য পলাশের সঙ্গেই বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন তাঁর বাবা পঙ্কজ অধিকারী, মা সবিতাদেবী ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী। সেখানে মারাথাহাল্লি (Marathahalli) মহকুমার ভারথুর (varthur) থানার সুলিবেলে (sulibela) গ্রামের কায়েন খাঁনের ডেরায় তাঁরা সবাই ওঠেন। দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরির শর্তে সেখানে তারা কায়েন খাঁনের অধীনে কাজ করা শুরু করেন। তাদের কাজ ছিল হোটেল, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত বর্জ্যবস্তু, বোতল, প্লাস্টিক সরঞ্জাম এইসব বাছাই করা।

পিন্টু হাওলাদারের কথায়, 'পলাশরা বেঙ্গালুরু যাবার পর প্রথম দিকে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। হঠাৎ করেই ওই বছরের ২৭ জুলাই সেখানকার ভারথুর (varthur) থানার পুলিশ কায়েন খাঁনের ডেরায় হানা দেয়। সেখানে যাঁরা যাঁরা বাংলাভাষী ছিল, তাঁরা সবাই নাকি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। এমন সন্দেহে ভারথুর থানার পুলিশ পলাশদের ও আরও পাঁচ জনকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যায়। ওই সময়ে পলাশ-সহ তাঁর স্ত্রী, বাবা-মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী, ভারথুর থানার পুলিশকে জানান যে তাঁরা কেউই বাংলাদেশি নন। তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে জানিয়ে নিজেদের আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড সবই দেখান। সেইসব দেখে সেখানকার পুলিশ পলাশের বৃদ্ধ বাবা, মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারীকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু, অদ্ভূতভাবে পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী এবং শিশুপুত্রকে ছাড়ে না । ভারথুর থানার পুলিশ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে তাঁদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে প্রায় ১০ মাস শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে পলাশ ও তাঁর স্ত্রী বেঙ্গালুরুর জেলে চোখের জল ফেলেই দিন কাটাচ্ছিলেন।

তার মধ্যে ভারথুর থানার পুলিশের তদন্তকারী দল তেলে গ্রামের বাড়িতে এসে সব কিছু দেখে যান। পলাশদের ভারতীয় নাগরিকত্ব সংক্রান্ত সমস্ত নথি নিয়ে যান। জামালপুরের বিডিও অফিস, থানা ও জেলা প্রশাসন থেকেও বিভিন্ন নথি তাঁরা সংগ্রহ করেন। তবুও পশাশদের জেল থেকে মুক্তি হয়নি। পলাশদের জেল মুক্তির জন্য দীর্ঘ আইনি লড়াই চালাতে গিয়ে উলটে তাঁর বাবা ও মা কার্যত নিঃস্ব হয়ে যান। অবশেষে গত ২৪মে বেঙ্গালুরু আদালত পলাশ ও তাঁর স্ত্রীর জামিন মঞ্জুর করে।

পলাশের দুই বোন সাথী ও শম্পা বুধবার বলেন, 'আমার দাদা, বৌদি ও ভাইপো ১০ মাস বাদে বেঙ্গালুরু জেল থেকে মুক্তি পেল ঠিকই। কিন্তু, দাদা-বৌদি ও ভাইপোর বাড়ি ফেরাটা বাবার আর দেখা হল না। চলতি বছরের ২৮ মার্চ বাবা পঙ্কজ অধিকারীর নিথর দেহ বেঙ্গালুরু থেকে তেলে গ্রামের বাড়িতে ফেরে। দাদা জেলবন্দি থাকায় আমরা দুই বোন মিলে বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করি। কিন্তু, দাদার অনুপস্থিতিতে থমকে ছিল বাবার পরলৌকিক ক্রিয়াকর্ম। দাদা বাড়ি ফিরলে সেই ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন হবে। আক্ষেপ প্রকাশ করে সাথী ও শম্পা বলেন, 'দাদা, বৌদি ও ভাইপোর বাড়ি ফেরার আনন্দের মধ্যেও বাবার জন্য বিষাদ রয়েই যাবে।'

আরও পড়ুন- ঢালাও যুক্তির জাল তছনছ, কত দিনের জেল হেফাজতে ‘কালীঘাটের কাকু’ সুজয়কৃষ্ণ?

জৌগ্রাম পঞ্চায়েতের তেলে গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য কৃষ্ণা সরকার বলেন, 'পলাশদের করুণ পরিণতি দেখে জৌগ্রাম এলাকার অন্যকেউ ভিনরাজ্যে কাজে যাওয়ার আর সাহস দেখাবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে ভারতের এক রাজ্যের জেলে ভারতীয় নাগরিকের ১০ মাস বন্দি থাকাটা নজিরবিহীন।'

Arrest Couples father
Advertisment