এক আদিবাসী যুবতীর নিরাপত্তার জন্য দিনভর পুলিশ তাঁর ছায়াসঙ্গী, পাশের ঘরে থাকেন পুলিশকর্মীরা। তাঁরা সরকারী কর্মচারী, টিভি দেখেন, খাওয়াদাওয়া করেন। এদিকে যাঁর নিরাপত্তা রক্ষার্থে তাঁরা রয়েছেন, সেই যুবতী তখন ঘরে মাকে নিয়ে হাতড়ে বেড়ান, কোথায় আছে একটু খাবার।
প্রাণরক্ষার দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু প্রাণরক্ষার জন্য পেট ভরানোর দায়িত্ব যেহেতু সরকারের নয়, তাই পুলিশের নিরাপত্তা কর্মী নিয়ে দিনমজুরির কাজ খুঁজতে যান যুবতী, কিন্তু নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে দিনমজুর কাজ করবে! সে কাজ মেলে না, অথচ খিদেটা বেড়েই চলে। সোমবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার মুখোমুখি হয়ে যুবতী বললেন, "একটা কাজ চাই, নাহলে আর পারছি না! সরকার পুুুুলিশ দিয়েছে আমার প্রাণ বাঁচাতে, কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে যে ক্ষিদেটাকে মারতে হয়, তার দায়িত্ব কে নেবে? আমার কী অপরাধ? আমি তো অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি শুধু।"
আরো পড়ুন: পাঁশকুড়ায় জমি রক্ষার প্রতিবাদে স্থানীয়রা, স্মৃতিতে নন্দীগ্রাম
আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে, সোমবার ২১ জানুয়ারি, বীরভূমের সুবলপুর গ্রামের কথা রাজ্য দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। কী ঘটেছিল সেদিন?
আদিবাসী ঐ তরুনীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল ভিন্নধর্মের এক যুবকের। তাঁর পরিবার সে সম্পর্ক মেনে নিলেও গ্রামের মোড়ল, মাতব্বর, রাজনৈতিক দাদারা তথা পঞ্চায়েত মানে নি। পাঁচ বছর আগে এই দিনে দুজন যখন গ্রামের পথে কথা বলছিলেন, তখন তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখেন গ্রামের মাথারা। খবর যায় পাশের গ্রামে মোড়ল মাতব্বরদের কাছে। সন্ধ্যার মধ্যে ট্রাক্টরে করে পাশের গ্রাম থেকেও মাথারা আসতে থাকেন। পঞ্চায়েতের হয়ে সালিশী সভায় আসেন তিন তৃণমূল নেতা সুজিত দাস বৈরাগ্য, অজয় মন্ডল ও দেবরাজ মন্ডল। তিনজনের সই করা সালিশী সভার কাগজ পরে খুঁজে পায় পুলিশ।
সালিশী সভায় যুবককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার পর ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু মোড়লরা সবার সামনে ঐ তরুনীর গণধর্ষনের নিদান দেন। হিংস্র পাশবিক উল্লাসে মেতে ওঠে সকলে, মদ-হাড়িয়া সহযোগে চলে ধর্ষণ উৎসব। দড়ির খাট ভেঙ্গে যায়, শীতের রাত্রে লাইন দিয়ে চলে গণধর্ষনের পালা। আর্তনাদ, কান্না সব চাপা পড়ে উল্লাসে।
পরদিন অনেক বেলায় সুবলপুরের এক গোয়ালঘরের পাশ থেকে উদ্ধার হন নিগৃহীতা। কতজন জড়িত ছিলেন অত্যাচারে? ১৩ টা মুখ মনে পড়েছিল যাঁদের চিনতেন নিগৃহীতা, তাঁদের নাম জানান পুলিশকে, যাঁদের মধ্যে সম্পর্কে বাবা-ছেলে বা নেতা মাতব্বর অনেকেই ছিলেন। তাঁরা এখন জেলবন্দী। "তবে সংখ্যাটা হয়তো আরও বেশী ছিল," অস্ফুটে বলেন নিগৃহীতা।
পাঁচ বছর পরে কেমন আছেন ঐ তরুণী, খোঁজ নিতে সোমবার আমরা গিয়েছিলাম লাভপুরে তাঁর গ্রামে। গ্রামের জনবসতি, ধানের ক্ষেত ছাড়িয়ে ফাঁকা এলাকায় পঞ্চায়েত তাঁর জন্য বাড়ি করে দিয়েছে, কারণ অন্য গ্রামবাসীরা তাঁর পড়শী হতে রাজী নন। ঐসব পড়শী বাড়ির পুরুষরাই গণধর্ষণে অভিযুক্ত হয়ে আপাতত জেলবন্দী। বাড়ির একটি ঘরে থাকেন পুলিশকর্মীরা, মোটামুটি সারাদিন টিভি দেখেন। এবং তরুণীর পরিবার খাওয়ার জল বা অন্য কোনো সামগ্রী বাইরে থেকে আনতে গিয়ে যাতে আক্রান্ত না হন, সেদিকে নজর রাখেন।
তরুণীর সাথে সংবাদমাধ্যমের কথা বলা বারণ, তবে অনেক চেষ্টার পর তিনি যা বললেন তা মোটামুটি এই, "আমি একা বাঁচছি, সরকার বাড়ি দিয়েছে, মা পায় ৭৫০ টাকার বার্ধক্য ভাতা। ঘটনার পর আমি ক্ষতিপূরণ হিসেবে নানা জায়গা থেকে সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম, সে টাকা ভাঙিয়ে পাঁচ বছর চলেছে তিনজনের। এবার সে টাকা শেষের মুখে, এখন একটা কাজ চাই। গতর খাটিয়ে খেটে খাব, কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। পুলিশ পাহারা সঙ্গে নিয়ে গেলে কেই বা কাজ দেবে আমাকে?
"পড়শীরা বলছে, আমি যাদের নামে অভিযোগ করেছিলাম, সেসব অভিযোগ তুলে নিতে হবে যাতে ওরা জেল থেকে ছাড়া পায়, না হলে এরা আমাকেই মারবে। কিন্তু আমার কী দোষ? আমার ওপর অত্যাচার হয়েছিল বলেই তো পুলিশে অভিযোগ করেছি। শুনছি এমন অত্যাচার নাকি এখনও হয়। আমি বলব, প্রতিবাদ করতে হবে, নাহলে ওদের অত্যাচার শেষ হবে না।"
আরো পড়ুন: বন্ধ জুট মিল, অভিযোগের মুখে তৃণমূলের ‘দাদাগিরি’
কিন্তু এর বাইরেও জীবন আছে, আছে বৃদ্ধা মা ও অসুুস্থ দাদাকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রশ্ন।সরকারের কাছে কাজ চান নিগৃহীতা। চান দূরে কোথাও পালাতে, যেখানে থাকবে না চেনা মুখ, যেখানে ভালোবাসতে গেলে সমাজপতি বা নেতাদের অনুমতি লাগবে না। এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে খাবারের খোঁজে থাকা নিগৃহীতা বলেন, "পুলিশ, সরকার, আইন আদালত ছিল বলে প্রাণে বাঁচলাম, কিন্তু আমি কেস তুলব না।"
সারাদিনই অবসর, তাই দেওয়ালে মাটি দিয়ে ছবি আঁকেন, উঠোনে ফুলগাছ লাগান, মহিলা পুলিশকর্মীদের সঙ্গে গল্প করেন। চিকিৎসকরা বলেন, মনের গভীরে লুকিয়ে থাকে যন্ত্রণা, আর সে যন্ত্রণার উপশম করতে লাগে অফুরান ভালোবাসা ও সহমর্মিতা। একজন নিগৃহীতা প্রতিবাদীকে "নোংরা" বা "সমাজচ্যুত" আখ্যা দেয় যে সমাজ, সেই সমাজের কি এবার আয়নায় মুখ দেখার দিন এসেছে?