লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় গেরুয়া শিবিরের উত্থানের পরেই রাজ্য জুড়ে শক্তি বাড়িয়েছে সংঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের হাত থেকে ছাত্র সংসদের দখল ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। এবিভিপি নেতৃত্বের দাবি, ২৩ মে-র পরে রাজ্যে প্রায় ৫০০ কলেজে তৈরি হয়েছে সংগঠনের ইউনিট। এর মধ্যে খান কুড়ি কলেজের ছাত্র সংসদের নিয়ন্ত্রণও তাঁদের হাতে। তবে সূত্রের খবর, গেরুয়া শিবিরের মতো এতখানি শক্তি বাড়াতে না পারলেও গত এক মাসে রাজ্যে উল্লেখযোগ্য শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলিরও।
আরও পড়ুন, ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় বেদম মার, অভিযোগ এবার ক্যানিং লোকালে!
২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে অধিকাংশ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েই কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিল এসএফআই-সহ বাম সংগঠনগুলি। গত আট বছর অব্যাহত ছিল রক্তক্ষয়। কিন্তু সম্প্রতি কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে বাম ছাত্র সংগঠন। কোথাও প্রায় এক দশক পরে তৈরি হয়েছে ইউনিট। কোথাও বছর আটেক গোপনে কাজ করার পর সম্প্রতি প্রকাশ্য কার্যকলাপ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে দীর্ঘ বিরতির পর ফের উড়তে দেখা যাচ্ছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের পতাকা।
এসএফআই সূত্রের খবর, তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার ও বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসের ছাত্র সংসদ কিছুদিন নিজেদের দখলে রেখেছিল সিপিএমের ছাত্র সংগঠন। এছাড়া, বিদ্যাসাগর কলেজের মর্নিং বিভাগ ও ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ ছিল এসএফআই-এর। কিন্তু এরপর ভিক্টোরিয়া ছাড়া অন্য সবকটি কলেজের ছাত্র সংসদ দখল করে টিএমসিপি। পরিস্থিতি এমন হয় যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসএফআই-এর প্রকাশ্য সাংগঠিনক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় বন্ধ হয়ে যায় ইউনিটও। কিন্তু সম্প্রতি সেই পরিস্থিতিতে কিছুটা বদল এসেছে।
সংগঠনের কলকাতা জেলা কমিটির নেতা অর্জুন রায় বলেন, "তৃণমূল ছাত্র পরিষদ পেশিশক্তির জোরে বিভিন্ন কলেজ থেকে বামপন্থীদের উৎখাত করে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছিল। সাংগঠনিক কার্যকলাপ চালানো দূরের কথা, আমাদের পোস্টার মারতেও দিত না তারা। কেবলমাত্র ভিক্টোরিয়া কলেজে আমরা প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ছাত্রী সংসদ ধরে রেখেছিলাম।"
তাঁর কথায়, "লোকসভা নির্বাচনের পর পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাসে আমরা দীর্ঘ বিরতির পর প্রকাশ্য সাংগঠনিক কার্যকলাপ শুরু করতে পেরেছি। জয়পুরিয়া কলেজ, মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজ, বিদ্যাসাগর কলেজের মতো বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এতদিন গোপনে কাজ করতে হত। সম্প্রতি ফের প্রকাশ্য সাংগঠনিক কাজকর্ম শুরু হয়েছে। ২০১১ সালের পর এই প্রথম সাউথ কলকাতা ল কলেজ, সাউথ সিটি কলেজের মতো তৃণমূল দুর্গে আমাদের ইউনিট তৈরি হয়েছে। আসলে টিএমসিপি বুঝতে পারছে, তাদের পায়ের তলার মাটি সরছে। ছাত্রছাত্রীরা ফের বামপন্থীদের সমর্থনে সক্রিয় হচ্ছেন।"
আরও পড়ুন, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি ‘কৃতজ্ঞ’ শাহরুফ চান ‘দোষী’দের শাস্তি
প্রসঙ্গত, তৃণমূলের প্রবল দাপটের মধ্যেও এসইউসি-র ছাত্র সংগঠন ডিএসও হাজরার যোগমায়া দেবী কলেজ এবং গোলপার্কের মুরলীধর গার্লস কলেজের ছাত্রী সংসদ একটানা নিজেদের দখলে রেখেছে। ওই দুটি কলেজ ধরলে এই মূহুর্তে কলকাতা বামপন্থীদের দখলে তিনটি ছাত্রী সংসদ।
কেবলমাত্র কলকাতা নয়। জেলার কলেজগুলির একাংশেও দীর্ঘ বিরতির পর বাম ছাত্র সংগঠনের কাজ শুরু হয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর মহাবিদ্যালয়, উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগর নেতাজী শতবার্ষিকী কলেজ, নৈহাটির ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজের মতো বিভিন্ন ক্যাম্পাসে দীর্ঘ কয়েক বছর এসএফআই-এর অস্তিত্ব ছিল না। সম্প্রতি ওই কলেজগুলিতে কাজ শুরু করেছেন বাম ছাত্রছাত্রী নেতৃত্ব। উত্তরবঙ্গের বালুরঘাট কলেজ ও বালুরঘাট গার্লস কলেজের মতো নিজেদের পুরনো ঘাঁটিতে ফের সক্রিয় হয়েছে আরএসপি-র ছাত্র সংগঠন পিএসইউ।
আরও পড়ুন, বিজেপির বিরুদ্ধে মমতার একসঙ্গে চলার আহ্বানে কী বলছে সিপিএম-কংগ্রেস?
এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যের কথায়, "তৃণমূলের সঙ্গে কোনওদিনই ছাত্রছাত্রীদের সমর্থন ছিল না। পুলিশের সাহায্যে বহিরাগত দুষ্কৃতিদের নিয়ে ওরা কলেজগুলো দখল করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা যেখানে যতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছি, টিএমসিপি পিছু হটছে। রাজ্যের শতাধিক কলেজে আমরা ফের সক্রিয় হয়েছি। এই সংখ্যা আরও বাড়বে।"
এবিভিপি প্রসঙ্গে এসএফআই রাজ্য সম্পাদকের কটাক্ষ, "মুকুল রায়, শঙ্কুদেব পণ্ডা, অর্জুন সিং-এর মতো দাগী তৃণমূলীরা এখন বিজেপি-র নেতা। বিজেপি আর তৃণমূলে কোনও ফারাক নেই। যারা টিএমসিপি-র হয়ে কলেজে তোলাবাজি, দাদাগিরি করত, তারাই জামা বদলে এবিভিপি হয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে সাংগঠনিক ভাবে এবিভিপি-র কার্যত কোনও অস্তিত্ব নেই।"
বাম ছাত্র সংগঠনের দাবি অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, "সামান্য কয়েকটি কলেজে বিজেপি অশান্তি, গোলমাল করছে ঠিকই। কিন্তু সিংহভাগ কলেজে আমাদের নিয়ন্ত্রণ অটুট রয়েছে। বামপন্থীরা নিজেদের ব্যর্থতায় এই কয়েক বছর অস্তিত্বহীন ছিলেন। কয়েকটি কলেজে তাঁরা ফের ইউনিট গঠন করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেকেরই রাজনীতি করার অধিকার আছে। কিন্তু তাতে আমাদের কোনও ক্ষতি নেই।"
এবিভিপি'র রাজ্য সভাপতি সুবীর হালদার বলেন, "রাজ্যে আপাতত বামপন্থীদের কোনও অস্তিত্ব নেই। একদিকে টিএমসিপি, অন্যদিকে আমরা - এর বাইরে আর কেউ নেই।"