ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা ফের একবার সংবাদ শিরোনামে। বাজি কারখানার আড়ালে কি বোমা তৈরি হচ্ছিল? ইতিমধ্যে তদন্তে নেমেছে এগরা থানার পুলিশ। এর আগে পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগরে একইভাবে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছিল। এগরার ঘটনা ফের সেই স্মৃতিকেই উস্কে দিয়েছে। তবে রাজ্যে 'অপরাধ কুটির শিল্পের' বাড়বাড়ন্ত রীতিমত আতঙ্ক তৈরি করেছে।
উত্তর ২৪ পরগণার কাঁকিনাড়ায় রেললাইনের ধারে খেলার সময় 'খেলনার বাক্স' ভেবে হাত দিতেই বিকট শব্দে সেদিনের বিস্ফোরণের স্মৃতি আজও টাটকা। ছয় মাসেরও বেশি সময় হয়ে গেছে কিন্তু আজও সেই ভয়াবহ দিনের ক্ষত বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে বছর ১১-এর মহেশ শাউ। নিন্মবিত্ত পরিবারের ছেলে মহেশ, সেদিনের বিস্ফোরণ বা'হাতের তালুর একাংশ কেড়ে নিয়েছে। চোখের সামনে বিস্ফোরণে ঝলসে যেতে দেখেছে কাছের বন্ধু নিখিল পাসওয়ানকে।
কব্জির চারপাশে মোড়ানো রুমাল মহেশকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেদিনের সেই টাটকা সকালের ভয়াবহ স্মৃতি। মাঝে মধ্যেই তা ভেবে শিউরে উঠছে ছোট মহেশ। তবে মহেশ বা নিখিলই নয়। বাংলা জুড়ে বোমার আঘাতে পঙ্গু অথবা হতাহত হয়েছে এমন শিশুর সংখ্যাটা রীতিমত চমকে দেবে। এনিয়ে শাসক-বিরোধী তরজা তুঙ্গে। বিজেপি দাবি করেছে যে ২০১৮ সাল থেকে বোমা হামলায় তাদের ২২৪ জন সমর্থক নিহত হয়েছেন, সিপিএম গত দুই বছরে তাদের ১৫ জন কর্মীর নিহতের দাবি করেছে।
তবে টিএমসি স্রেফ এটিকে প্রচার হিসাবে উড়িয়ে দিয়েছে। এই সপ্তাহের শুরুতে এগরা বাজি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৯টি তাজা প্রাণ ঝলসে যাওয়ার ঘটনায় NIA তদন্তের দাবি জানিয়েছে বিজেপি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনৈতিক মহলে নতুন করে ঝড় উঠতে শুরু করেছে।
যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার NIA তদন্তে সরকারের কোন আপত্তি নেই বলেও সাফ জানিয়েছেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তদন্তে দেখেছে মাত্র এক বছরে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পাঁচটি জেলা জুড়ে বোমার আঘাতে ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং ১৮ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। এমন ২৪ টি পরিবারকে খুঁজে বের করেছে। জেলাগুলির মধ্যে রয়েছে বর্ধমান, বীরভূম, মালদা, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
উত্তর ২৪ পরগনা
উত্তর ২৪ পরগনার কাঁকিনাড়ায় রেললাইনের ধারে খেলার সময় 'খেলনার বাক্স' ভেবে হাত দিতেই বাঁ হাতের তালুর একাংশ উড়ে গিয়েছে ছোট মহেশের। হাতে রুমাল জড়ানো মহেশ জানিয়েছে, "৬ মাস কেটে গেলেও ক্ষতস্থানে মাঝে মধ্যেই তীব্র যন্ত্রণা আমাকে আজও কাঁদায়। এত ব্যাথা হয় যে স্কুলেও যেতে পারি না মাঝে মধ্যে। পরিবারের প্রশ্ন, 'আমরা কীভাবে আমাদের বাচ্চাদের সারা দিন তালাবদ্ধ করব?' এটা কী আদৈও সম্ভব! সেদিনের কথা মনে করতেই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে মহেশের।
সে জানায়, “সেদিনটা ছিল দিওয়ালির ঠিক পরের দিন। নিখিল আর আমি রেললাইনের কাছেই মাঠে খেলতে গিয়েছিলাম। আমরা দুটি ছোট ধাতব বাক্স দেখে সেটাকে খেলনা ভেবে খেলতে গিয়েছিলাম। নিখিল একটা আমার হাতে দেয়। বাক্সটি খোলার চেষ্টা করতেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। আমার হাত ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং আমি দৌড়ানোর আগেই আমি নিখিলকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখি"।
বাবা অরুণ কুমার শাউ, পেশায় জেলে, মা হোসিয়ারি কারখানায় কাজ করেন। পরিবারের কথায়, " সেদিনের বিকেল আমাদের পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। স্থানীয় টিএমসি নেতারা হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দিলেও ছেলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য আমাদের ক্ষতিপূরণ খুবই প্রয়োজন"। মাত্র ১০ মিনিট দূরেই নিখিলের বাড়ি। নিখিলের মা কুসুম, সেদিনের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, "আমরা সেই ভয়াবহতার কথা আর মনে করতে চাই না,"
এই ঘটনায় পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করলেও তারা বর্তমানে জামিনে মুক্ত। সিনিয়র এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, "এই ধরণের ঘটনা আমাদের কাছে একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ। “গ্রেফতার হওয়া আসামীরা কিছুদিনের মধ্যে জামিন পেয়ে জেলের বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রতিটি ঘটনায় সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও এটা সত্যি যে অনেক আসামি রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও, যখন পুলিশ বিশেষ অভিযান চালায়, গ্রেফতারি এড়াতে বোমাগুলি প্রকাশ্যে ফেলে দেয় তারা। ”
মহেশের বাড়ি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর, অপর একটি বিস্ফোরণে দুজন আহত হওয়ার পর থেকে বাবা-মা'রা আর তাদের সন্তানদের খেলার জন্য বাইরে যেতে দেন না। যে মাঠে সেদিন বিস্ফোরণ হয় তার কাছেই গান্ধী বিদ্যালয়। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১১৩ জন ছাত্র-ছাত্রী সেখানে নিয়মিত ক্লাস করছে। ঘটনার পর স্কুল-কর্তৃপক্ষ সচেতনতা ছড়াতে বিশেষ ক্লাসের আয়োজন করে।
প্রধান শিক্ষিকা নন্দিতা শর্মা জানিয়েছেন, "ঘটনার পর থেকে আমরা পড়ুয়াদের স্কুলের বাইরে খেলতে দিইনা"। একই জেলার তৃতীয় হামলার শিকার সোহানা খাতুন ওরফে ঝুমা। গত বছরের ১৬ নভেম্বর সোহানার মামার বাড়ির ছাদে পাওয়া একটি বস্তু তুলে নেওয়ার পরই প্রবল বিস্ফোরণে নিহত হয় ছোট সোহানা এবং তার বন্ধু রহিমা পারভিন সেই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়।
ঘটনায় সোহানার এক নিকট আত্মীয়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। যিনি স্থানীয় তৃণমূল নেতা। স্থানীয় পঞ্চায়েত আপ-প্রধান আবদুল হামিদ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, “এটি একটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছিল। আমাদের দলের কিছু কর্মী এমন অসামাজিক কাজে লিপ্ত। দল কোনভাবে এইধরণের কাজকে সমর্থন করে না।
বর্ধমান
২২শে মার্চ, ২০২১- বছর সাতেক শেখ আবরোজ বল ভেবে বাড়ির পাশের বাগানে বল পাশের বাগানে কুড়িয়ে পাওয়া একটি বস্তু তুলতেই হয় প্রকট বিস্ফোরণ। মৃত্যু হয় আবরোজের। গুরুতর আহত হন তার বন্ধু শেখ ইব্রাহিম। আব্রোজের মা সানিয়া বিবি বলেন, "বাগান করার জন্য মাটি তুলে আনতেই ঘটে বিপত্তি। বিকট শব্দ শুনতে পেয়েই ছুটে যাই। বিস্ফোরণে মুখ ও হাতের একটি অংশ উড়ে যায় ছেলের। বর্ধমান হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে"।
বাবা শেখ বাবলু বলেন, “আমার ছেলে আর ফিরবে না। রাজ্য সরকার আমাকে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দিয়েছে। আমার ছেলের জীবনের দাম কী ২ লাখ টাকা? এই ঘটনায় ইতিমধ্যেই একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে কিন্তু এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা
নরেন্দ্রপুরের আটঘোরা গ্রাম! যেখানে গত বছরের ২৮শে অক্টোবর বোমা বিস্ফোরণে দু'ই ব্যক্তি গুরুতর আহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৪ বছরের কম বয়সী পাঁচ শিশু আহত হয়৷ আদর্শ শিশু নিকেতনের ছাত্র লাল্টু আঢ্য পায়ে স্প্লিন্টারের আঘাত এখনও স্পষ্ট। লাল্টু জানিয়েছে, বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটি মাঠে খেলার সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। লাল্টুর মা সঞ্চিতা আঢ্য বলেন, "সেদিন ছেলের জন্মদিন ছিল। আমার ছেলে এবং আরও চারটি শিশু রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়িতে দৌড়ে আসে। দুই সপ্তাহ স্কুলে যেতে পারেনি। তারপর থেকে এখন আমরা বাচ্চাদের বাইরে খেলতে দিই না,”। ঘটনায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, কিন্তু কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
বীরভূম
২৭ মে, ২০২১ সন্ধ্যায় তার দাদা শেখ জামিরের সঙ্গে গিয়ে শেখ নাসিরুল (১১) একটি ধাতব বাক্স দেখেই সেটিকে খেলনার বাক্স ভেবে তুলতেই বিকট শব্দে হয় বিস্ফোরণ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় নাসিরুলের। পুলিশি হয়রানির ভয়ে পরিবার থানায় কোন অভিযোগ দায়ের করেনি। বাবা শেখ আউসার বলেন, "পুলিশ এসে আমাদের বিবৃতি নিয়েছিল কিন্তু কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি, মেলেনি কোন ক্ষতিপূরণও। সমব্যথি স্কিম থেকে মাত্র ২ হাজার টাকা সাহায্য পেয়েছি" । রামপুরহাটেও ছয় বছর ৬-এর নাজমা গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি তার বাড়ির পিছনে পাওয়া একটি বস্তু তুলে নেওয়ার পরে বিস্ফোরণে মারা যায়। বিস্ফোরণে তার চার বন্ধুও আহত হয়েছে।
মালদা
গোপালনগরে, গত বছরের ২৫ নভেম্বর এক বোমা বিস্ফোরণে শুভজিৎ সাহা (৯), মিঠুন সাহা (১১), পলু সাহা (৬), বিক্রম সাহা (১১) এবং রায়হান শেখ (১০) স্প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হন। সবচেয়ে বেশি আঘাত পান শুভজিৎ। তার মা মুক্তি সাহা (৩০) বলেন, 'ছেলের চিকিৎসায় হাজার হাজার টাকা খরচ হলেও কেউ আমাদের এক টাকাও দেয়নি'।
জাতীয় শিশু অধিকার কমিশনের একটি দল গোপালনগরে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করে। ঊর্ধ্বতন এক পুলিশের কর্মকর্তা বলেন, “কমিশন আমাদের কাছে একটি রিপোর্ট চেয়েছিল। আমরা তা কমিশনকে দিয়েছি। আমরা ইতিমধ্যে ওই ঘটনায় চার্জশিট দাখিল করেছি।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কমিশনার অলোক রাজোরিয়ার সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলেছে, তিনি জানিয়েছেন, " আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। তবে শুধু অভিযানই নয় আমরা শিশু ও তাদের পরিবারকে সতর্ক করছি । স্কুল ও পাবলিক প্লেসে প্রচার চালাচ্ছি। রাস্তা বা আবর্জনা থেকে কিছু না তুলতে বারেবারে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।"