স্বনির্ভর গোষ্ঠী (সেলফ হেল্প গ্রুপ) তৈরিতে ‘দেশের সেরা’ স্বীকৃতি পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গর্বের সঙ্গে সেকথা ঘোষণা করেছিলেন। ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশনের বিচারে বাংলার এই শিরোপা পাওয়ার কথা মাস সাতেক আগে। আর আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের মুখে সেই গর্ব চুরমার করে দেওয়ার অভিযোগ উঠল পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের এক তৃণমূল নেতা, বিডিও, পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান ও মহিলা গ্রাম সেবিকার (এলজিএস) বিরুদ্ধে। প্রশাসনের কাছে তাঁদের বিরুদ্ধে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অনিয়মে মদত দেওয়ার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন একাধিক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রীরা। যা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় পড়ে গিয়েছে জেলা প্রশাসন ও রাজ্যের শাসক দলের অন্দরে।
জামালপুরের দোলোরডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মিরাতাজ শেখ (বেগম)। জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপার-সহ প্রশাসনের নানা মহলে দায়ের করা অভিযোগে তিনি নিজেকে 'নারী চেতনা মহিলা মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড'-এর একজন পদাধিকারী বলে দাবি করেছেন। মিরাতাজের অভিযোগ, 'নারী চেতনা মহিলা মাল্টি পারপাস কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের নামে বেআইনি নথিপত্র তৈরি করে এবং তাঁর সই নকল করে জামালপুরের দুটি পৃথক ব্যাংকের শাখায় অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। যাঁরা মিলে পরিকল্পনা করে ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো খুলেছেন, তাঁদের মধ্যে ব্লকের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার, পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি তথা বর্তমান ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মেহমুদ খান, এলজিএস চন্দনা ঘোষ, জামালপুর ১ পঞ্চায়েতের প্রধান ডলি নন্দী, উপপ্রধান সাহাবুদ্দিন মণ্ডলও রয়েছেন।'
মিরাতাজ তাঁর দায়ের করা অভিযোগে আরও জানিয়েছেন যে, তাঁর সই নকল করে তৈরি করা দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখা দাস নামে একজনকে নেত্রী সাজানো হয়েছে। আর ওই দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেনের মাধ্যমে কমবেশি 'আড়াই কোটি টাকা' আত্মসাৎ করে নেওয়া হয়েছে। মিরাতাজ বেগম তাঁর অভিযোগে এ-ও জানিয়েছেন, খুবই গোপনে নারীচেতনা কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের নামে দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। তাই তিনি এবং তাঁদের গোষ্ঠীর অনেকেই সেটা জানতে পারেননি। কিছুদিন আগে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর তিনি দুটি ব্যাংকে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, 'ব্লকের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার, পঞ্চায়েত সমিতির পূর্বতন সভাপতি মেহমুদ খান, এলজিএস চন্দনা ঘোষ এবং তাঁদের সঙ্গীদের কথায় ওই অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।'
মিরাতাজ জানিয়েছেন, একথা জানতে পারার পরেই তিনি জামালপুর থানায় অভিযোগ জানাতে যান। থানা অভিযোগ নিতে অস্বীকার করায় অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার কোঅপারেটিভ সোসাইটির কাছে তিনি সবিস্তারে জানান। পরে সমস্ত নথিপত্র নিয়ে এই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার কারণ জানতে বিডিওর কাছে পৌঁছন। মিরাতাজের অভিযোগ, তাঁকে বিডিও বলেন, 'তুমি মহিলা হয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করছ। তুমি যদি ভাল চাও, তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে যে যে জায়গায় অভিযোগ দায়ের করেছ, সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নাও।' মিরাতাজ বলেন, 'বিডিও সাহেব এমন হুমকি দেবেন, সেটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। তাই আমি নিরুপায় হয়ে জেলাপ্রশাসনের বিভিন্ন দফতর ও মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে অভিযোগ জানিয়ে গোটা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানাতে বাধ্য হয়েছি।'
এই অভিযোগের বিষয়ে জেলাশাসক প্রিয়াংকা সিংলা বলেন, 'অভিযোগপত্র পেয়েছি। খুবই গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগের তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।' সংশ্লিষ্ট দফতরের জেলা প্রকল্প আধিকারিক আনন্দ ধারা বলেন, 'অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে আসার পর পরবর্তী যা পদক্ষেপ নেওয়ার, নেওয়া হবে।' জেলার পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন বলেন, 'এমন বিষয়ে অভিযোগ আমার দফতরে দাখিল হয়ে থাকলে, অবশ্যই তার তদন্ত হবে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
আরও পড়ুন- পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি, কী ‘মারাত্মক’ আশঙ্কা DA আন্দোলনকারীদের?
শুধু মিরাতাজ বেগম একাই নন। স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে এমন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আরও অনেক গোষ্ঠীর মহিলারাও করেছেন। জামালপুর-২ এবং আঝাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা যে সব বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন, তা-ও যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মতই। জামালপুর-২ পঞ্চায়েতের 'শ্রীমা মহিলা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড'-এর সদস্য সুমিতা বর ও তপতী মালিক বলেন, 'স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে চূড়ান্ত অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণ চলছে। এলজিএস এবং প্রোজেক্ট ডিরেক্টর (পিডি)-সহ যাঁরা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজকর্ম দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁদের ঘুষ না-দিলে কোনও গোষ্ঠী কাজ পায় না। আবার ঘুষ দিলেও যে কাজ মিলবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই। গোষ্ঠীর মহিলাদের প্রশিক্ষণের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা দুর্নীতি হয়।'
সুমিতা ও তপতী বলেন, 'কোনও দল নেই, বডি মেম্বারও নয়, ব্যাংক লোন নিয়ে শোধ করেনি, এমন কাউকে কাউকেও অনিয়ম করে সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ যাঁরা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার যোগ্য, তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ধান ব্যবসা ও প্রাণী পালন ছাড়াও স্কুল ড্রেস নিয়ে সবথেকে বড় মাপের অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে। শ্রীমা মহিলা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্যরা ব্লক ও জেলা প্রাশাসনের কাছে অভিযোগ করে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।'
জামালপুরের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা এ-ও জানান, 'বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজকর্ম সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল জামালপুরে আসে। তখন তাঁদের কাছেও ব্লকের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর মহিলারা সমস্ত অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছিলেন। এর কিছুদিন পরেই নাটকীয়ভাবে এলজিএস চন্দনা ঘোষকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়।' অন্যদিকে আঝাপুর পঞ্চায়েতের নারীশক্তি সংঘ মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেডের বডি মেম্বার উমা দাস বলেন, 'বছরের পর বছর ধরে আঝাপুরের বাসিন্দা ঝরনা বেগম একাই স্কুল ড্রেস দেবার অর্ডার পেয়ে যাচ্ছেন। এর পিছনেও রয়েছে বড়সড় কেলেঙ্কারি। প্রশাসন সঠিক তদন্ত করলে এই দুর্নীতিতে জড়িত রাঘব বোয়ালদের মুখোশ খুলে যাবে।' প্রশাসন দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা না-করলে, ব্লকের সকল প্রতারিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা মিলে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন বলেই উমা দাস হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
এই বিষয়ে বিডিও (জামালপুর) শুভঙ্কর মজুমদার বলেন, 'আমাকে দায়ী করে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেগুলো সবই অসত্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কোনও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গোষ্ঠীর সমস্ত নথিপত্র যাচাই করে নিয়ে তা করেন। এই বিষয়টি ব্যাংক ও গোষ্ঠীর নিজস্ব বিষয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ও ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার বিষয়ে ব্লক কিংবা জেলা প্রশাসন বা পঞ্চায়েতের কোনও সম্পর্কই নেই। হুমকি দেওয়ার যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেটাও অসত্য।' এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি বলে বিডিও দাবি করেছেন।
স্কুল ড্রেসের অর্ডার ঝরনা বেগমের একার পাওয়া নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, সেই প্রসঙ্গে বিডিও বলেন, 'পূর্বেকার বছরে স্কুল ড্রেসের জন্য ব্লকের ১৩টি গোষ্ঠী ঝরনা-র গোষ্ঠীর নাম প্রস্তাব করেছিল।' চলতি বছর ব্লকের একাধিক গোষ্ঠী স্কুল ড্রেস তৈরির কাজ করছে বলেও বিডিও দাবি করেছেন। পাশাপাশি বিডিও এ-ও বলেন, 'কোন কাজ কার মাধ্যমে হবে, সেই সিদ্ধান্ত সর্বোপরি সরকারই নিয়ে থাকে। সরকারও নিশ্চয় ঝরনা বেগমকে যোগ্য মনে করেছিল, তাই সে স্কুল ড্রেসের অর্ডার পেয়েছিল।' বিডিও এ-ও জানান, স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে এত সমস্যা তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ হল অধিকাংশ গোষ্ঠীর বডির মেয়াদ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও ভোট না-হওয়া।
সমবায় আইনে গোষ্ঠীগুলোর নির্বাচন করানোর জন্য থাকা প্রিসাইডিং অফিসারের পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকার কারণে গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। যদিও ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মেহমুদ খান দাবি করেছেন, 'বিডিও সাহেবের উপস্থিতিতে হওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে নারীচেতনা কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের বডি চেঞ্জ হয়েছে। সরকারি আইন মোতাবেক হওয়া ওই নির্বাচনের বিষয়ে বিডিও এবং এলজিএস ম্যাডাম সব জানেন।' নারীচেতনার সমস্ত সদস্যরা ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বলেই মেহমুদ খান দাবি করেছেন। তাঁর কথায়, 'এরপর নারীচেতনার নামে ক'টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল, সেটি বিডিও এবং এলজিএস ম্যাডাম জানেন।' স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অর্থ নয়ছয় এবং দুর্নীতির সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ প্রশাসন পেলে, আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেই পারে বলে মেহমুদ খান হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।