খাটে শুয়ে অসুস্থ গৃহবধূ। আর সেই খাট বাঁশ আর দড়ি দিয়ে পালকির মতো বেঁধে বেহাল রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিয়ে যাচ্ছেন অসুস্থ গৃহবধুর পরিবারের লোকেরা। যদিও শেষ পথে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় ওই গৃহবধূর। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন ভাইরাল ভিডিও ছড়িয়ে পড়তে তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছে মালদায়।
মর্মস্পর্শী এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই নিন্দার ঝড়। ফের একবার স্মৃতির পাতা থেকে উঁকি দিচ্ছে ওড়িশার কালাহান্ডি এবং এরাজ্যেরই জলপাইগুড়ির দু'টি ঘটনা। ওড়িশায় সরকারি হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর মরদেহ নিয়ে যাওয়ার গাড়ি না পেয়ে নিজের কাঁধে দেহ তুলে হাঁটা লাগিয়েছিলেন দানা মাজি। এরপরের ঘটনা ছিল জলপাইগুড়ির। সরকারি হাসপাতাল থেকে মায়ের মরদেহ নিয়ে যেতে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করতে না পেরে দেহ কাঁধে তুলে হাঁটা লাগিয়েছিলেন ছেলে। এবার অবশ্য ঘটনা সামান্য ভিন্ন। বেহাল রাস্তার জেরে প্রাণ খোয়াতে হল বছর চব্বিশের এক গৃহবধূকে।
ঘটনাটি মালদহের আদিবাসী অধ্যুষিত বামনগোলার গোবিন্দপুর মহেশপুর পঞ্চায়েতের মালডাঙা গ্রামের। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, গ্রামের এই কাঁচামাটির রাস্তায় কোনও গাড়ি ঢুকতে চায় না। তাই ওই গৃহবধুর পরিবারের লোকেরা মাচা তৈরি করে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন ওই গৃহবধূকে। কিন্তু শেষমেশ আর তাঁকে বাঁচানো যায়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃতের নাম মামনি রায় (২০)। দুই বছর আগে এলাকার বাসিন্দা কার্তিক রায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মামনির। সম্প্রতি তিনি জ্বরে ভুগছিলেন বলে খবর। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় এলাকার বাসিন্দারা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করেন। খাটিয়াতে শুইয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁচানো যায়নি মামনিকে। বাড়িতে তাঁর ২ বছরের এক সন্তানও রয়েছে। বেহাল রাস্তার বলি হলেন বছর কুড়ির গৃহবধূ।
মৃতের আত্মীয়দের বক্তব্য, বেশ কিছুদিন ধরেই মামনি জ্বরে ভুগছিলেন। মালডাঙা থেকে মোদিপুকুর গ্রামীণ হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। প্রায় ৫ কিলোমিটার গ্রামের বেহাল রাস্তায় কোনও যানবাহন চলে না। হাতে কিছু টাকা থাকলেও প্রত্যেকেই নিরুপায়। কারণ অ্যাম্বুলেন্স হোক বা যে কোনও ভাড়া গাড়ি, এই গ্রামের রাস্তায় আসার কোনও ব্যবস্থাই নেই। কাঁচা মাটির রাস্তা এতটাই বেহাল কোনও গাড়ি ঢোকে না।
এদিকে, শুক্রবার রাত থেকেই ওই গৃহবধূর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ভোররাতে বহুবার ফোন করলেও অ্যাম্বুলেন্স রাস্তা খারাপের জন্য আসতে চায়নি। শেষমেশ কোনও উপায় না পেয়ে পরিবারের লোকজন খাটিয়ায় দড়ি বেঁধে ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন মামনিকে। সেই ছবি-ভিডিওই ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সংশ্লিষ্ট এলাকার গ্রামবাসীদের বক্তব্য, বেহাল রাস্তার জন্য বিডিও অফিসে বহুবার গিয়েছেন তাঁরা। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে রাস্তা মেরামতির। কিন্তু পরবর্তীতে কোনও কাজ হয়নি। সেই পরিস্থিতিতে খাটিয়া করে নিয়ে যেতে হয় রোগীনিকে।
আরও পড়ুন- আদপে কাটোয়ার কার্তিক লড়াই কী? জানুন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদের বক্তব্য
এবিষয়ে তৃণমূলের জেলা সহ সভাপতি বাবলা সরকার বলেন, "এই ধরনের ঘটনার কথা জানা নেই। রাজ্য সরকার যেভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে তাতে এমন ঘটনা ঘটার কথা নয়। তবে যদি এটা ঘটেও থাকে তাহলে খতিয়ে দেখা হবে।"
অন্যদিকে, বামনগোলা ব্লকের বিজেপি নেত্রী বিনা কীর্তনীয়া বলেন, "রাজ্যজুড়ে নাকি গ্রামীণ এলাকায় প্রচুর রাস্তাঘাট হচ্ছে। রাস্তার যে কী উন্নতি হয়েছে তা ভাইরাল হওয়া সোশ্যাল মিডিয়ার এই ছবি পরিষ্কার বলে দিচ্ছে। বেহাল রাস্তার কারণে অসুস্থ গৃহবধূর সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে জীবন চলে গেল। অথচ প্রশাসন নিশ্চুপ। যদি সত্যিই গ্রামীণ এলাকার রাস্তার উন্নয়ন হতো তাহলে বামনগোলার মধ্যযুগীয় বর্বরতার এমন ছবি দেখতে হতো না ২০ বছরের মামণিকে। পঞ্চায়েত ও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই তাকে জীবন হারাতে হলো।"