Hemen & Co Musical Instrument Shop: কলকাতা রাসবিহারীর কাছে এক কোণায় ছোট্ট দোকান। বাইরে থেকে দেখলে অবাক করার মতন কিছুই মনে হয় না। দোকানের বাইরে ঝুলকালি আর মাথার উপরে পুরনো সাইনবোর্ড দেখলে আন্দাজ করা যায় বয়স। রাস্তায় এমনিতে ভিড় কম। দোকানের সামনে এক মনে কাজ করছেন মাঝ বয়স্ক এক লোক। সামনে এসে দাঁড়ালে কাঠ পালিশ করার কড়া গন্ধ নাকে আসে। প্রথম দেখাতে আহামরি কিছু মনে না হতে পারে। আসল সম্পদই তো লুকিয়ে রয়েছে দোকানের ভিতরেই। চার দেওয়ালের যে দিকে চোখ যায় যেন সুরের জাদুকরেরা এই দোকানের সাক্ষী হয়ে আছেন। হেমেন অ্যান্ড কোং কলকাতার ৮২ বছরের পুরনো এক বাদ্যযন্ত্রের দোকান। যে দোকানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে সংগীতের প্রতি তীব্র আবেগ। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, বিটলসের মতন তাবড় তাবড় সঙ্গীত শিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছে এরাই। যে কাজ আজও নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছেন।
সালটা ১৯৪২, হেমেন চন্দ্র সেন প্রথম এই দোকানটি শুরু করেন। হেমেন বাবু নিজেও একজন সংগীত বিশারদ ছিলেন। মাইহার ঘরানার বাবা আলাউদ্দিন খানের শিষ্য। এই দোকানের বর্তমান কর্ণধার রতন কুমার সেন। হেমেন চন্দ্র সেনের সন্তান। রতন বাবুই বলছিলেন দোকানের পুরনো ইতিহাস," আমার বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের পছন্দের ছাত্র ছিলেন। ভীষণ ভালোবাসতেন। একদিন আলাউদ্দিন খানের কাছেই সেতার শেখার সময় হাত থেকে পরে সেটি ভেঙ্গে যায়। বাবার কাছে নতুন সেতার কেনার সামর্থ্য ছিল না। ওস্তাদ নতুন সেতার কেনার জন্যে টাকা দিতে চাইলে বাবা তা নিতে অস্বীকার করেন। নিজের চেষ্টাতেই ভাঙ্গা সেতার সারাই করে ফেলেন। আলাউদ্দিন এতে অবাক হয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ওনার ভাঙ্গা সেতার সব আমার বাবাকে সারাই করতে বললে বাবা রাজি হয়ে যান। তখন থেকেই শুরু। এরপর পণ্ডিত রবিশঙ্কর থেকে ওস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত নিখিল ব্যনার্জী থেকে অন্নপূর্ণা দেবী সকলেই আমাদের দোকানের একনিষ্ঠ খদ্দের ছিলেন।"
পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে আলাপের সৌজন্যেই বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের সঙ্গে হেমেন এন্ড কোং এর যোগসূত্র তৈরি হয়। জর্জ হ্যারিসন,ইয়ান অ্যান্ডারসন, ইহুদি মেনুহিনের মতন আন্তর্জাতিক শিল্পীরা বাদ্যযন্ত্র কিনে নিয়ে যায়। ১৯৬৮ সাল জর্জ হ্যারিসন এই প্রথম জীর্ণ দোকান থেকে একটি সেতার কিনেছিলেন। আর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন এদের বাদ্যযন্ত্র শিল্পের আশ্চর্য সব কাজে। তাই পরে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি দুটি অ্যাকোস্টিক গিটারেরও অর্ডার দিয়েছিলেন। কিন্তু হেমেন এন্ড কোং-এর মালিক এই আইকনিক সংগীতকারের কাছ থেকে কোনও টাকা নিতে চাননি। যার ফলে তাঁকে 'ধন্যবাদ' স্বরূপ একটি বিশাল জার্মান টেপ রেকর্ডার দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। যেটি যত্ন করে রেখেছেন রতনবাবু। রতনবাবু নিজেও এককালে সঙ্গীত চর্চা করতেন। বার্ধক্যজনিত কারণে এখন বন্ধ করে দিয়েছেন। ''নতুন প্রজন্মের অনেকে কোন কিছু না জেনেই যে কোনও বাদ্যযন্ত্র কিনে ফেলে। বাদ্যযন্ত্র কেনার আগে সঠিক বেঠিক যাচাই পর্যন্ত করতে জানে না। এখন কলকাতা শহরে ভুঁড়ি ভুঁড়ি বাদ্যযন্ত্রের দোকান। কোন দোকান ভাল কোনটা নয়, কেউ জানে না। নতুনদের সেতারে আগ্রহে কোনও খামতি নেই। তবে ওই যে! কোনও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়ার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে। শেখার প্রতি আগ্রহ কারও নেই।" খানিকটা অভিযোগের সুরে দোকানে বসে বলছিলেন রতন কুমার।
কলকাতা শহরে এত বাদ্যযন্ত্রের দোকান থাকা সত্ত্বেও হেমেন অ্যান্ড কোং আজও বুদ্ধিমত্তার সাথে টিকে আছে। নতুন এবং পুরনোর মেলবন্ধনে দেশের এবং বিদেশের সকল সঙ্গীতপ্রেমীদের প্রতিটি চাহিদা পূরণ করে চলেছে। বিদেশের মাটিতে এই দোকানের বাদ্যযন্ত্রের ভালোই রপ্তানি আছে। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন তো বটেই নতুন শিল্পীদের মধ্যে পণ্ডিত রবিশঙ্করের কন্যা অনুস্কা শঙ্কর, ওস্তাদ বিলায়ত খান, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, রশিদ খান, আরতি মুখার্জি এবং আরও অনেকে এই হেমেন বাবুর দোকানের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছেন। ১৭৪এ রাসবিহারী অ্যাভিনিউর এই দোকানে ভারতের এমন কোন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী বাকি নেই যাদের পদধূলি এই দোকানে পড়েনি। হেমেন সেন অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট দুটি ২০০১ সালে হাফিজ আলী খান পুরস্কার এবং বিদ্যার্থী সম্মান পুরস্কার। ৮২ বছরের বৃদ্ধ এই দোকান বয়সের ভারে অনেকটা জীর্ণ। নতুনত্বের প্রলেপ গায়ে না লাগলেও পুরনো ঐতিহ্যকে আজও ধরে রেখেছে। তাই এখন কোনও এক বিকেলে খোঁজ করতে করতে দোকানের ভিতর ঢুকে পড়ে বিদেশ থেকে আসা কোন এক সঙ্গীতপ্রেমীর দল।