বাঙালি সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়ার তালিকাটি বর্তমানে অনেক লম্বা। সেকালের জমিদারদের বুলবুলি-লড়াই কিংবা গিলে করা পাঞ্জাবির সঙ্গে কোঁচানো ধুতি। কজন মানুষ মনে রেখেছেন এসব? সবই তো ঢুকে গিয়েছে ভুলে যাওয়ার খাতায়। ঠিক যেমন ভুলে গিয়েছে সুগন্ধি বিলাসী আতরকেও। বাবুবিলাসের নিশি ফুরনোর সঙ্গে সঙ্গেই আতরের আদরও যেন শূন্য হয়ে গিয়েছে। কার্নিশের নকশা ঝুলনি, খড়খড়ি আর ঝোলা বারান্দা। উঁচু বাড়ির দেওয়াল বেয়ে নেমে আসা গাছের শিকড়। শহরের বুকে এসব দেখলে যেন মনে হয় ইতিহাস জীবন্ত দাঁড়িয়ে।
এমনিতেই ৩০০ বছরের পুরনো কলকাতার রাস্তাঘাটে খুঁজলেই মাঝেসাঝে বেরিয়ে পড়ে অতীতের স্মৃতিরা। ঠিক এমনই এক ঐতিহাসিক জায়গা চিৎপুর। নাখোদা মসজিদের গা ঘেঁষে চলে যাওয়া গিয়েছে রবীন্দ্র সরণি। এই রাস্তায় এসে দাঁড়ালে বোঝা যায় কলকাতার ব্যাস্ততা। বাড়ির গায়ে বাড়ি। ঠ্যালা গাড়ির যানজট। মানুষের ভিড়। সারিবদ্ধ দোকান।
কোলাহলময় কলকাতা শহর। নাখোদা মসজিদ থেকে একটু এগিয়ে চার-পাঁচটি দোকান পার করলেই চারদিকে মম করছে আতরের খুশবু। জাকারিয়া স্ট্রিট প্রাচীন কলকাতার এক সময়ের আতর সাম্রাজ্যে। আর এই আতরের দুনিয়ার বেতাজ বাদশা, 'হাজী খুদা বক্স ও নবি বক্স পারফিউমার্স'। এই দোকান আলাদা করে জায়গা করে নিয়েছিল কলকাতার তাবড় তাবড় মানুষের মনে। সময়টা ১৮২৪ সাল। প্রায় দুশো বছরের বেশি পুরনো এই দোকান। এই দোকানের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি থেকে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান, শেখ মুজিবর রহমান, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। এঁদের সকলের বাড়ির আতরের বরাত যেত, হাজী খুদা বক্স নবি বক্স পারফিউমার্স-এর কাছ থেকে।
ইতিহাস বলছে, উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কেশ তৈল, সাবান, প্রসাধনী ও গায়ে মাখার সুগন্ধি অর্থাৎ আতর। ১৮৫৬ সালে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ নির্বাসিত হয়ে কলকাতায় আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন সুগন্ধি আতর। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে শহরে আতরের ব্যবসাও ডালপালা মেলতে থাকে। তবে নবাবের আসার ঢের আগে অর্থাৎ ১৮২৪-এ কনৌজ থেকে খুদা বক্স এবং তাঁর ছেলে নবি বক্স কলকাতায় চলে আসেন সুগন্ধির ব্যবসা করতে। লোয়ার চিৎপুর রোডে তখনও গ্যাসবাতি বসেনি। আলো বলতে ভরসা ছিল কেরোসিনের বাতির ওপর। গঙ্গাতীরের চিৎপুর তখন বাণিজ্যে জমজমাট। কিন্তু অন্ধকারে খরিদ্দার মেলা ভার! তাই ভোর থেকেই বেচাকেনার শুরু।
ভোর পাঁচটায় রবীন্দ্র সরণি আর কলুটোলার কোণে ফৌজদারি বালাখানার একতলায় দোকান খুলে বসে পড়তেন হাজি খুদা বক্স। সারাদিন রমরমিয়ে চলত ব্যবসা। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঝাঁপ পড়ে যেত। তখনও এখানে নাখোদা মসজিদ তৈরি হয়নি। সেই তখন থেকে দোকান আজও একই জায়গায় রয়েছে। যদিও মসজিদ তৈরি হয়েছে এ সবেরও বহু পরে। মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় আরও কয়েকটি আতরের দোকান রয়েছে বটে, তবে সব থেকে পুরনো দোকান খুদা বক্স। কোনও এক অজানা কারণে কলকাতার আতর সাম্রাজ্য এ অঞ্চলের বাইরে তেমন বাজার তৈরি করতে পারেনি।
খুদা বক্স ও নবি বক্স পারফিউমার্সের অষ্টম বংশধর নিয়াজুদ্দিন আল্লা বক্স দোকানেই বসে বলছিলেন, "১৮২৪ এর আগে লখনউতে স্বাধীনতা সংগ্রাম তখন তুঙ্গে। ইংরেজদের সাথে খুব ঝামেলা চলছে। ব্যবসার ভীষণ ক্ষতি হচ্ছিল। খুদা বক্স কলকাতায় চলে আসার জন্যে মনস্থির করেন। কলকাতা সম্ভবত তখন দেশের রাজধানী হয়ে গিয়েছে। ১৮২৪ সালে দোকান শুরু হয়। শৌখিন বাঙালিবাবুরা এই সুগন্ধি পছন্দ করতে লাগলেন। ব্যবসা ভালই চলতে লাগল। আমরা শুনেছি রবীন্দ্রনাথের প্রথম পছন্দ ছিল গোলাপ আর জুঁইয়ের গন্ধ। তখন এ শহরেও আতর তৈরি হত। বেঙ্গল কেমিক্যালের উল্টো দিকের ফুলের বাগিচার ফুল দিয়ে। যদিও স্বাধীনতার আগেই সে ফুল বাগিচা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন কনৌজ থেকেই আতর আসে।"
সুগন্ধ এমন একটি জিনিস যা সারাসরি প্রভাব ফেলে মন এবং মেজাজের উপর। নাকের অভ্যন্তরে উপস্থিত সেন্সারি এপিথেলিয়াম অসংখ্য সেন্সারি নিউরোনকে ধারণ করে। এই নিউরোনগুলো প্রকৃতিতে উৎপন্ন গন্ধযুক্ত কণাগুলিকে চিহ্নিত করে মস্তিষ্কে প্রেরন করে। যারফলে কোন সুন্দর সুগন্ধ পেলে মাত্র মন ভাল হয়ে যায়। ফুল ভাল লাগার পিছনে এই সুগন্ধই অন্যতম প্রধান কারণ।
আরও পড়ুন শাঁখের করাতই জীবন, ঝুঁকি কাঁধে বারো মাস কাজ করেন শঙ্খশিল্পীরা
গরমে বেল, জুঁই, গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দনের পাশাপাশি মনের আরাম দেয় খস সুগন্ধি। আগেরকার দিনে গরমে, পাটের ঝোলানো খসে জল ছিটিয়ে ঘর ঠাণ্ডা রাখা হত। আতরের 'বেস' হল চন্দন তেল। দুর্মূল্য চন্দন তেল পাওয়ায় এখন দুষ্কর। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের মিশ্রণে তৈরি খাঁটি আতরের দামও হয় সব থেকে বেশি। ভাল আতর নিতে গেলে ১২ এমএল আতরের দাম পড়বে ৩০০ থেকে শুরু করে ৩০০০ টাকা। গরমের মধ্যে যেমন ব্যবহার করা যেতে পারে 'বেলা', 'চামেলি', 'খস'। সব থেকে দামি আতরের মধ্যে রয়েছে 'হায়াতি', 'মুস্ক', 'মজমুয়া', 'শ্যামামা' কিংবা 'গুলাব'।
এখন ফুল বাগান বা বাগিচা সেভাবে আর কলকাতাতে দেখা যায় না। তাই এই শহরে আতর তৈরিও বন্ধ হয়েছে। চারদিকে কংক্রিটের জঙ্গল। আতরের আঁতুড়ঘর বলতে এখন উত্তরের কনৌজ, দক্ষিণ-পশ্চিমে মুম্বই। সেখান থেকেই শিশি-ভরা আতর পাড়ি দিচ্ছে শহর কলকাতার আদিতম আতরের দোকানে। যদিও ফুল দিয়ে তৈরি হয় না এসব আতর। বলছিলেন, হাজি খুদা বক্সের কর্ণধার নিয়াজুদ্দিন। "কেমিক্যাল দিয়ে বানানো সব সুগন্ধ চলে যাচ্ছে আতরের মধ্যে। সেখানে সত্যিকার ফুলের গন্ধ পাওয়া খুব মুশকিল। বছর দশক আগে আতরের চাহিদা একদম কমে গিয়েছিল। কিছু বছর হল আতরের বাজার ফিরছে। অনেকে পারফিউমের বদলে এখন আতর ব্যবহার করছেন। ইদ আর পুজোর আগে সুগন্ধ আতরের চাহিদাও বেড়েছে অনেকটা।"
খুদা বক্সের দোকানের অন্দরমহলজুড়ে নানা রঙের আতরের সমাহার। সুগন্ধের আড়ালে ইতিহাসকে যেন সযত্নে আগলে রাখছে। এই একটি মাত্র দোকান যেখানে সুগন্ধের মানচিত্রে একসঙ্গে মিলে যাচ্ছে নবাবি আমল এবং ঠাকুরবাড়ি, বাংলার সে কাল আর এ কাল।