লড়াই যেন তাঁর রক্তে। ঘরে-বাইরে সারা জীবন লড়াই চালিয়ে তিনিও এক ‘ফাইটার’। ছোটবেলায় দারিদ্রর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে তিনি যেমন মা, ভাই, ৪ দিদির দায়িত্ব একা কাঁধে নিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়েছেন। সেই তিনিই আবার জলপাই রঙের পোশাক পরে দেশবাসীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সে কাজ করতে গিয়েই বৃহস্পতিবার উপত্যকায় শহিদ হলেন হাওড়ার বাউড়িয়ার বাবলু সাঁতরা।
শোকে বিহ্বল সাঁতরা পরিবারের চোখে-মুখে এখন শুধুই বাবলুর স্মৃতি। সেই স্মৃতি আওড়াতে গিয়েই বাবলুর আরেক ‘লড়াই’য়ের কাহিনী সামনে এল। বাবলুর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, অত্যন্ত দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে নিজের পায়ে দঁড়িয়েছেন নিহত এই জওয়ান।
আরও পড়ুন, পাকিস্তানকে দেওয়া ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’-এর তকমা প্রত্যাহার ভারতের
তখন বাবলু সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সেসময়ই বাবাকে হারান বাবলু। এরপর মা, ভাই ও ৪ দিদির সব দায়িত্ব একাই নিতে হয় তাঁকে। চেঙ্গাইলে শ্রী বিদ্যানিকেতন স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি রোজ সকালে চেঙ্গাইল বাজারে ঠাকুমার সঙ্গে মাছ বিক্রি করত ছোট্ট বাবলু। তার আগে অবশ্য ঠাকুমার সঙ্গে মাছের আড়তেও যেত সে। সাংসারিক জীবনের এই লড়াই চালিয়েই ৪ দিদির বিয়ে দিয়েছেন বাবলু। আর এসবের ফাঁকে ভলিবল খেলতে ভুলতেন না বাবলু। কারণ ভলিবল খেলতে খুব ভালবাসতেন বাংলার এই জওয়ান।
আরও পড়ুন, রুপোর আংটিই চেনাল কাশ্মীরে নিহত বাংলার জওয়ানকে
একদিকে মাছ ব্যবসা, অন্যদিকে পড়াশোনা আর সংসারের ভার, সব মিলিয়ে সেই সপ্তম শ্রেণির ছাত্রটি বোধহয় তখনই বুঝে গিয়েছিল, তাঁর লড়াকু জীবন। সেকারণেই উলুবেড়িয়া কলেজে পড়তে পড়তেই সিআরপিএফে চাকরি পেয়ে গেলেন বাবলু। সালটা ১৯৯৯, সিআরপিএফে যোগ দিলেন বাবলু। সেই পথচলার শেষ হল ১৪ ফেব্রুয়ারি। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বাংলার এই ‘ফাইটার’-এর দেহ।
নতুন বাড়িও তৈরি করেছিলেন বাবলু। কিন্তু নিজের হাতে গড়া সেই বাড়িতে আর থাকা হল না তাঁর। সেই বাড়িতে রেখে গেলেন স্ত্রী মিতা সাঁতরা, মেয়ে, মা ও অন্য পরিজনদের। বাবলুর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, নতুন বাড়িতে রঙের কাজ হয়নি এখনও। গত ডিসেম্বরেই বাড়িতে এসেছিলেন বাবলু। জানুয়ারিতে যাওয়ার সময় কথা দিয়েছিলেন, মার্চে ফের বাড়ি আসবেন। মার্চের আগেই অবশ্য আসছেন, তবে কফিনবন্দি হয়ে। বাবলুর আর ৬ মাস চাকরি ছিল। চাকরি থেকে অবসর নেবেন নাকি ফের চাকরি করবেন, এ নিয়ে ভেবে দেখবেন বলেছিলেন। কিন্তু সে আর হল কই!
আরও পড়ুন, কাশ্মীরে জঙ্গি হামলায় শহিদ হাওড়ার জওয়ান
ঘরের ছেলেকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল বাবলুর পরিজনরা। দাদার শোকে কাতর ভাই কল্যাণ সাঁতরা বললেন, ‘‘২ মার্চ দাদার বাড়িতে আসার কথা ছিল। যাদের জন্য এমনটা হল, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’’ বাবলুর আরেক আত্মীয় চন্দন দাস ক্ষোভের সুরে বললেন, ‘‘একের পর এক জওয়ানের উপর হামলা হচ্ছে। নিরাপত্তা রক্ষা করছেন যাঁরা, তাঁদেরই নিরাপত্তা থাকছে না। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক সরকার।’’ আরেক পরিজন স্বপন সাঁতরা বললেন, ‘‘আর যেন কোনও মায়ের কোল খালি না হয়।’’