বুদ্ধবাবুকে দইয়ের ভাঁড়ের কাগজে চিঠি লিখেছিলাম: বৈশাখী

"আমার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যে মানুষগুলোর কখনও আসার কথা ছিল না, শোভনদার সূত্রে রত্না চ্যাটার্জির মতো সে মানুষগুলো আমার জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট করেছে। এজন্য রাগ হয়।"

"আমার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যে মানুষগুলোর কখনও আসার কথা ছিল না, শোভনদার সূত্রে রত্না চ্যাটার্জির মতো সে মানুষগুলো আমার জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট করেছে। এজন্য রাগ হয়।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Baisakhi Banerjee Exclusive Interview

মমতাকে নিয়ে অনেক ক্ষোভ বৈশাখীর

তিনি মুখ খুললেই খবর আর বিতর্ক। ইউটিউবে তাঁর নামে সার্চের সংখ্যা টেক্কা দেবে টলিউডের হুজ-হুদেরও! পয়লা বৈশাখের ঠিক আগে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধরা গেল বেনিয়াপুকুরের মিল্লি আল আমিন কলেজের প্রিন্সিপালের দফতরে। ছোট্ট ঘর, এসি নেই৷ সহ-শিক্ষিকা আর গ্রুপ ডি স্টাফদের হরেক আব্দার শোনার ফাঁকে বৈশাখী জানালেন, তিনি বিজেপির প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়েছেন ঠিকই, তবে আজ না হোক তৃণমূলকে জবাব দেবেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তিনি নাকি চিঠি লিখেছিলেন দইয়ের ভাঁড় মোড়ার কাগজে! শোভন চট্টোপাধ্যায়ের 'বান্ধবীদের' নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা নেই, তবে প্রাক্তন মেয়রের প্রতি রাগ শুধু একটি কারণে। এমনই আরো অনেক কথা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানালেন বৈশাখী।

Advertisment

বিজেপি কি লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছিল?

হ্যাঁ। বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব যোগাযোগ করেছিলেন৷ আমার সিভি ওঁদের পছন্দ হয়েছিল। প্রথম নির্দিষ্টভাবে কোনও কেন্দ্রের কথা বলা হয়নি, নির্বাচনের দিন ঘোষণার পর ডায়মন্ড হারবার-সহ একাধিক কেন্দ্রের কথা বলা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ওঁরা বারবার করে বলছিলেন, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু হিসাবে ওঁরা আমাকে চাইছেন না। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, আমার সংগ্রামের ইতিহাস দেখেই আমাকে প্রার্থী করতে চান। আমার এই অ্যাপ্রোচটা ভাল লেগেছিল। কিন্তু আমি প্রথমেই ওঁদের না করে দিই।

কিন্তু কেন?

Advertisment

দেখুন, আমি তো ওই কেন্দ্রগুলির মানুষের জন্য কিছুই করিনি। কেন হঠাৎ ভোট চাইতে যাব! তাছাড়া যাঁরা দীর্ঘদিন বিজেপি করেছেন, বিজেপি-র হয়ে মার খেয়েছেন, লড়াই করেছেন, তাঁরা টিকিট পাবেন না আর আমি বাইরে থেকে গিয়ে প্রার্থী হব, এমনটা আমি চাইনি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূল কংগ্রেস আপনার বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ করেছেন৷ কখনও মনে হয়নি এসবের জবাব দেওয়া দরকার?

জবাব তো আমি দেবই। ঠিক সময়েই দেব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল আমার সঙ্গে যা করেছে, তা অসম্ভব যন্ত্রণার। যেভাবে আমার ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে কাদা ছোড়া হয়েছে, আমাকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে, অকল্পনীয়! এর উত্তর আমি দেব। আমাকে কেউ অন্যায়ভাবে যন্ত্রণা দিলে আমার ভিতরে একটা জেদ তৈরি হয়। আমি সেই অন্যায়ের জবাব দিই।

কীভাবে জবাব দেবেন? ইলেক্টোরালি?

তৃণমূল কংগ্রেস তো রাজনৈতিক দল। তাদের সেভাবেই জবাব দেব। দেখা যাক, সময় আসুক।

আপনি বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আপনার যোগাযোগের কথা বলছিলেন....
হ্যাঁ! আমি জানি না আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর মতো সংবেদনশীল কিনা। আপনি জানেন, আমি ওঁকে দইয়ের ভাঁড় মোড়ার কাগজে চিঠি লিখেছিলাম!

তাই নাকি! কবে?

সেটা ২০০৪ সালে। আমার ২৩-২৪ বছর বয়স। সিপিএমের এক নেতা, নাম নিজামুদ্দিন, তখন আমাদের মিল্লি আল আমিন কলেজ নিয়ন্ত্রণ করেন। উনি ধর্মীয় প্রসঙ্গ তুলে আমাকে কিছুতেই কলেজে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। আমারও জেদ চেপে গেল, এই কলেজেই পড়াব। আদালতে গেলাম। অশোক গাঙ্গুলির ডিভিশন বেঞ্চ আমার পক্ষে রায় দিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু লাভ হল না। গায়ের জোরে আমাকে কলেজে পড়াতে দিচ্ছিল না সিপিএমের লোকজন। আমি তখন ডেসপারেটলি মুখ্যমন্ত্রীকে মিট করতে চাইছি। একদিন আমি গাড়ি করে যাচ্ছি, দেখলাম রাস্তার এক জায়গায় খানিকটা ভিড়। আমি চালকের কাছে জানতে চাইলাম, ওখানে কী হচ্ছে। উনি বললেন, ওটাই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি। বুদ্ধবাবু সম্ভবত বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন বা ফিরলেন সদ্য। আমি তখনই গাড়ি থেমে নামলাম, সিকিউরিটিকে বললাম, বুদ্ধবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

তারপর কী হল?

সিকিউরিটি কর্মী বললেন, এভাবে তো দেখা করা সম্ভব নয়, আপনি আপনার যা প্রয়োজন একটা কাগজে সংক্ষেপে লিখে ফোন নম্বর দিয়ে যান। আমি তো পড়লাম আতান্তরে! তখন কোথায় কাগজ পাব, একটা কলম রয়েছে শুধু কাছে। আমি করলাম কী, একটা ছোট্ট মিষ্টির দোকানে গিয়ে কাগজ চাইলাম। ওঁরা আমাকে দইয়ের ভাঁড় মোড়ার কাগজ দিলেন। আমি সেই রকম ১৩টা কাগজে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখলাম। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, কী সমস্যা হচ্ছে, আদালতের রায় - সব লিখলাম। শেষে ফোন নম্বর দিলাম। বাড়ি ফেরার খানিকক্ষণ পর একটা ফোন এল। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের ফোন, রাইটার্সে যেতে বলা হল! আমার স্বামী তো বিশ্বাসই করছিল না এমন হতে পারে।

যাক গে, আমি রাইটার্সে গেলাম। একজন আধিকারিক বললেন, "আপনি কখনও মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন নি, না? এভাবে কেউ চিঠি লেখে?" একটা অফিসিয়াল লেটার লিখতে হল। বুদ্ধবাবু ডাকলেন। সব শুনে জাস্ট একটা ফোন করে আমার চার বছরের সমস্যা মিটিয়ে দিলেন। ভাবা যায়! আমি কিন্তু কখনও এসএফআই করিনি, সিপিএম করিনি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কী বলবেন?

জানেন, আমি প্রথম ভোট দিতে যাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দেব বলে। একজন মহিলা, ওঁর মতো একজন মহিলাকে ভোট দেব বলে। মমতা যেদিন শপথ নিতে যাচ্ছেন, আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছিল৷ ওঁর লড়াইটার সঙ্গে আমি আমার লড়াইটাকে মেলাতে পারছিলাম। সেই মানুষ কীভাবে আমার জীবনটাকে কালিমালিপ্ত করলেন! শুধু আমি নই, আমার একরত্তি মেয়ে, আমার বৃদ্ধা মা - সবাইকে। দেখুন, আমার সঙ্গে যদি কারও বন্ধুত্ব থাকে, তাহলে আমার যতটুকু দায়িত্ব, সেই বন্ধুরও তো ততখানিই দায়িত্ব। তাই না? তিনি ওঁর ক্যাবিনেটের মন্ত্রী, উনি তাঁকে (শোভনকে) বলতে পারতেন। আমার নাম কেন নেবেন? এতখানি অসংবেদনশীল মনোভাব আমি একজন মহিলার থেকে পেলাম!

তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার শুরুতে তো পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল...

আমাদের সাসপেনশনের সময়, সুলতান আহমেদের সঙ্গে যখন লড়ছি, পার্থদা ভীষণ সাহায্য করেছিলেন। সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তারপর উনি আমাকে ওয়েবকুপার দায়িত্ব দেন। তৃণমূলের একজন বুদ্ধিজীবী সাক্ষী, আমি বিধানসভায় সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে পার্থদাকে বলেছিলাম, আমি ওই দায়িত্ব নিতে চাই না। আমি প্রেসিডেন্সিতে আইসি'র সঙ্গে ছিলাম। আমি আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসকে প্রকট করতে চাই না। তাও উনি আমাকে দায়িত্ব দিলেন। আমাকে লোকে পার্থদার ঘনিষ্ঠ বলতে শুরু করল। পরে শোভনদার সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্ব হল। আসলে কী জানেন, আমি মেয়ে তো, মেয়ে বলেই বোধহয় একটা ছায়া দরকার বলে মনে করা হয়। কিন্তু আমার কারও ছায়ার প্রয়োজন নেই।

শোভনদার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে এত বিতর্ক, খারাপ লাগে না?

লোকে যখন বলে, শোভনদা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন, আমার হাসি পায়। ওঁরা জানেন না শোভনদা আমায় কী দিয়েছেন। উনি, এই সাংঘাতিক শভিনিস্ট সমাজে, সম্ভবত একমাত্র পুরুষ, যিনি একজন মহিলার সম্মানের জন্য নিজের এত বড় পজিশন, এত ক্ষমতা - সব হেলায় ছেড়ে দিয়েছেন। যদি কেউ বলে উনি আমায় এত শাড়ি বা এত গয়না দিয়েছেন, তাহলে আমি বলব, এসব আমার এত আছে যে তোমাদের উপঢৌকন দিতে পারি৷ ব্যক্তি শোভনদাকে আবিষ্কার করতে না পারলে কেউ জানতেই পারবে না তিনি বন্ধু হিসাবে কতটা অসামান্য।

ইউটিউবে আপনাকে নিয়ে যত সার্চ, টলিউডের নায়িকাদের নিয়ে তা নয়। অধ্যাপিকার চাকরি করে এই সেনসেশনকে কীভাবে দেখেন?
আমার এসব মনে দাগ কাটে না। উল্টে মেয়েটাকে নিয়ে ভয় হয়। আমার মেয়ে শোভনদাকে দুষ্টু বলে ডাকে। এখনকার সব বাচ্চারা যেমন, ওর হাতেও স্মার্টফোন। কার্টুন খুঁজতে খুৃুঁজতে হঠাৎ বলে, "মা, তোমার আর দুষ্টুর ছবি!" এখন তো শুধু ছবি দেখছে, পরে যখন পড়তে শিখবে, তখন কী হবে! আমি তো ভিডিওগুলোর নীচে করা কমেন্টগুলো দেখি। এরা এত ইনসেনসিটিভ! নারীদের একতাল মাংস বলে মনে করে শুধু।

শোভনদার তো অন্য বান্ধবীরাও ছিলেন...

ছিল মানে কী, আছে! প্রচুর মহিলা বন্ধু ওঁর। কেউ কাউন্সিলর, কেউ বিধায়ক, কেউ অভিনেত্রী। তাঁদের সঙ্গে শোভনদার বাড়িতেই আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। আমার তো কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই। নিজের সঙ্গে ছাড়া কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা নেই।

আপনার মা এই বিতর্কে কীভাবে নিয়েছেন?
মা তো শোভনদাকে খুব স্নেহ করেন। তার জন্য মাকে বহু কটু কথা শুনতে হয়েছে। তবে এই যে এতবড় ঝড় বয়ে গেল, মা একবারও জানতে চাননি কী হয়েছে। শুধু বলেছেন, তোমার সুপিরিয়র কেউ সমালোচনা করলে মাথা নীচু করে শুনবে, কিন্তু ইনফিরিয়র কেউ সমালোচনা করলে উপেক্ষা করবে।

শোভনদা আপনাকে কমপ্লিমেন্ট দেন না কখনও?

একদম না। যদি সবাই বলে আমাকে দারুণ লাগছে, তাও উনি একবারও বলেন না। আসলে আমার মনে হয়, এই অবয়বটা যদি পুরুষ হত, তাও উনি আমায় ভালবাসতেন।

কোনও অভিযোগ নেই শোভনদার প্রতি?

আছে। একটা কারণেই প্রবল রাগ হয় ওঁর প্রতি। আমার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যে মানুষগুলোর কখনও আসার কথা ছিল না, শোভনদার সূত্রে রত্না চ্যাটার্জির মতো সে মানুষগুলো আমার জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট করেছে। এজন্য রাগ হয়। জানেন, ওদের ডিভোর্সের মামলা চলছে। আমি কোর্টে বসে আছি, শোভনদার জন্য ওয়েট করছি। আমার স্কুলের এক শিক্ষিকা এসে বলে গেলেন, "তোর গায়ে এক গামলা কাদা দিয়ে গেলেও কেউ বিশ্বাস করবে না তুই খারাপ। তুই সেই এক জেদী বৈশাখী ব্যানার্জি, যে হাউজ ক্যাপ্টেন ছিল। তখন হাউজকে জেতাতে লড়তিস, এখন শোভনকে জেতাতে লড়ে যা।" বলে আমাকে দু'টো টফি দিলেন - একটা আমার, আরেকটা শোভনদার। শোভনদাকে বললাম, উনি শুনে কেঁদে ফেললেন। এটাই প্রাপ্তি।

tmc bjp