Banglar Chalchitra: এই বাংলা শিল্পীর দেশ, শিল্পের দেশ। এখানে ঘরে ঘরে শিল্পীর বাস। প্রকৃতিও যেন শিল্পের ভাণ্ডার নিয়ে সেজে আছে। এই যেমন বাবুই পাখি! আর তার ছোট বাসা! এই ছোট্ট জীবও ঠোঁটে খড়কুটো নিয়ে বুনে যায় শিল্পের অট্টালিকা। নিরক্ষর কিন্তু অসমান্য শিল্পবোধ। হাতের কাছে পাওয়া অতি সাধারণ জিনিস দিয়েই তৈরি করে ফেলতে জানে অসামান্য শিল্প। এতসবের পরেও দুর্ভাগা এই দেশে শিল্পী আর শিল্পের কদর বোঝে ক'জন? ঝুলিতে না পাওয়ার ভাগটাই তো সব থেকে বেশি। অগোচরে ফুরিয়ে যাচ্ছে বিচিত্র সব শিল্পকর্ম। ঠিক বাবুই পাখির বাসার মতন। গ্রামেও আর দেখা মেলে না। যেমনটা চোখে না পড়ে না দুগ্গা ঠাকুরের পিছনে অর্ধবৃত্তের একটা ক্যানভাস। যাকে আমরা চালচিত্র বলি। পুরনো খবরের কাগজ জুড়ে জুড়ে তৈরি অর্ধ গোলাকার একটা ক্যানভাস। তার উপরেই তুলির টানে, নানা রঙের ব্যবহারে ফুটে উঠত বিভিন্ন দেবদেবীর অবয়ব। শিব, পার্বতী, কালী, চণ্ডী আরও কত কী!
এই হারিয়ে যাওয়া সময়ে দাড়িয়ে এই শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন রেবা পাল। বয়স আশির কাছাকাছি। চোখের দৃষ্টি আবছা হয়ে আসছে। বয়সের ভারে শরীর ভেঙে পড়েছে। তবু তিনি হাল ছাড়েননি। এখনও শ্বশুড়বাড়ির পূর্বপুরুষের পেশা আগলে ধরে রেখেছেন। বাংলার আদি ঐতিহ্যশালী শিল্পকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। জীর্ণ ছাদের তলায়। বাবুই পাখির মতনই তারঁ বাসা। কৃষ্ণনগরের বহুল পরিচিত জায়গা ঘূর্ণি। ছোট রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে গলির শেষ প্রান্তেই রেবা পালের মাথা গোজার আস্তানা। দু'পাশে পাকা দালান বাড়ির মাঝে বড্ড বেমানান তাঁর বাড়ি। বর্ষাকালে উঠোনে শ্যাওলা জমে পিছল। বাড়ির চতুর্দিকে পাঁচিল নেই, বাঁশ দিয়ে ঘেরা। দেখাশোনা করার লোক না থাকায় বাড়ির চারপাশে আগাছাও বেড়েছে। দূর থেকে দেখলে পরিত্যক্ত বাড়ি বলে মনে হয়। বৃষ্টির দিনে জল চুয়ে চুয়ে পড়ে বাড়ির বারান্দায়। আর সেই বারান্দাতে বসেই চালচিত্রে তুলি বুলিয়ে চলেছেন বৃদ্ধা।
ষোলো বছর বয়সে বিয়ে করে আসেন এই বাড়িতে। বাপের বাড়িতে এসব ছবি আঁকাআঁকির ধারে কাছেও ছিলেন না রেবা দেবী। বিয়ের পরেই স্বামীর হাত দিয়ে চালচিত্রে হাত বুলানোয় হাতেখড়ি। এরপর কেটে গিয়েছে দীর্ঘ ষাট বছর। স্বামী ছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর ষষ্ঠী পাল। নুন আনতে সংসারে পান্তা ফুরায়। অপটু হাত লেগে পড়ল স্বামীর আঁকা ছবিতে রং মেশাতে। শিক্ষানবিশ থেকে হয়ে উঠলেন সুদক্ষ শিল্পী। দুহাতের জাদুতে আঁকতে শিখেছেন অসাধারণ সব পটের ছবি। বারন্দার এক চিলতে অংশটুকুই ওনার ঘাড় গুঁজে বসে কাজ করার জায়গা। এখানেই বসেই নিয়মিত কাজ করেন।
কাজের ফাঁকেই রেবা পাল বলছিলেন তাঁর জীবনের গল্প, "ছোট জায়গার উপর আমার স্বামী দু কামরার এই ঘর তৈরি করেছিলেন আমার জন্যে। তিন মেয়ে এক ছেলের সংসার। বিয়ের এক বছরের মাথায়, আমার স্বামী আমাকে প্রথম বলে পটের ওই শিব,দুর্গায় একটু রং করে দাও তো! আমিও কাজে লেগে গেলাম। উনি কলকাতায় বিভিন্ন ঠাকুরের কাজ করতেন, ঠাকুরের কাজ তো আর সারা বছর থাকতো না। অবসর সময়ে বসে দুর্গাপট আঁকতেন। আগে এক চালার দুর্গা হত। বাড়ির পুজোর জন্যে পটের চাহিদা ভালোই ছিল। কলকাতাতে পাইকারি জোগান দিতে স্বামী স্ত্রী দুজনে পুরো দমে লেগে পড়লাম। ভালোই চলছিল। চালচিত্র বিক্রি করতে মাঝে সাঝে স্বামীর সঙ্গে কলকাতাতেও যেতাম। বিশেষ করে দুর্গা পুজোর সময়। ভোরের ফার্স্ট লোকালে চলে যেতাম। ওনার হাত ধরে কলকাতাকে চিনেছি। দিনভর বিক্রি বাটা সেরে সন্ধ্যার লোকালে ফিরে আসতাম কৃষ্ণনগর। এই রোজগারের টাকাতেই ছেলেমেয়ের বিয়ে দিলাম। উনি মারা যাওয়ার সময় বলেছিলেন, চালচিত্র আঁকা ছেড়ো না। স্বামীর কথার খেলাপ করিনি আজও। তখন থেকে একাহাতে স্বামীর শিখিয়ে যাওয়া শিল্পকে ধরে রেখেছি।"
আগের মতন পরিশ্রম করতে পারেন না রেবা পাল। করোনার সময়তেও কুমারটুলি, কালীঘাট ঘুরে পট দিয়ে আসতেন। এখন জীর্ণ শরীর হার মানছে। তবুও ইচ্ছে শক্তির উপর ভর করে রোজ আঁকতে বসেন নিয়ম করে। কেউ কিনতে আসুক আর নাইবা আসুক উনি এঁকে চলেন। পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক খুবই কম। আগে পট আঁকা হত খবরের কাগজের উপর। তবে তা টেকসই হত না। এখন মোটা আর্ট পেপারে পট তৈরি হয়। চারহাত, এক হাত বিভিন্ন মাপের। সাবুর আঠা জাল দিয়ে তারপর সাদা ক্যানভাসে রং-তুলি দিয়ে এঁকে ফুটিয়ে তোলা হয় সপরিবার দেবী দুর্গা। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে এক সময়ে এই পট শিল্পের বেশ রমরমা ছিল। রেবা পালের কথায়, ওনার বাড়ির আস পাশেই অনেক শিল্পী ছিলেন, এখন তারা আর কেউ নেই। শিল্পীদের ভাষায়, এই পট আঁকা আসলে ‘পট লেখা’। আগে পট লেখার এই কাজ চলত সারা বছর ধরেই। এখন আর হয় না। সরকারের তরফ থেকেও এই শিল্পীদের কোন সাহায্যে মেলেনি। "একজন শিল্পী হিসেবে নুন্যতম মর্যাদাটুকু পায়নি সরকারের কাছে। আমার বাড়িটুকুই সম্বল। আমার স্বামীর ভিটে। প্রতি বছরই বাড়ছে রং ও আঠার দাম। আর্থিক অনিশ্চয়তার জন্য এই পেশায় শিল্পীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রতিমা কিংবা সাজের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে কেউ চালচিত্র কিনছে না। চালচিত্রের দরকার হলে কম্পিউটারে সস্তায় প্রিন্ট আউট করে নিচ্ছে!" এসবই আক্ষেপ করে বলছিলেন রেবা পাল।
স্বামীর রেখে যাওয়া আলো আঁধারি ঘরটায় যেন স্বর্গসুখ আছে। ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনও ভাবতেই পারেন না। যেমনটা ছাড়তে পারছেন না চালচিত্রকে। ভিটে মাটির মতোই তিনি আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। ক্লান্তি নেই। দু'চোখে আত্মবিশ্বাস। এঁকে চলেন। তাঁর উঠোন জুড়ে ভেসে বেড়ায় পুরনো স্মৃতিরা। সঙ্গী বলতে এই চালচিত্র। জীর্ণ ঘরে আগমনীর গান শোনা যায়। কাশবনের মতোই তাঁর ঘর ভরে থাকে চালচিত্রে। দূর থেকে কেউ এলে আঁকা থামিয়ে একগাল হেসে বলেন, "চালচিত্র দেখবে বুঝি! একটু চা করি? একটা বিসকুট অন্তত খেয়ে যাও, তা না হলে গেরস্থের অমঙ্গল হবে!"