সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নায়িকা দেবী চৌধুরানীর জীবনকথা যে সত্যি ঘটনার ওপর আধারিত, তা অনেকেরই জানা। দেবী চৌধুরানীর ছায়াসঙ্গী ভবানী পাঠক কোথাকার বাসিন্দা ছিলেন কেউ জানেন কি? জানতে চাইলে দিল্লী ভিটা চাঁদের খালে চলে যান, সেখানে ইতিহাস কথা বলে। দেবী চৌধুরানীর স্মৃতি বিজড়িত দিল্লী ভিটা চাঁদের খালে ফি বছর পৌষ পূর্ণিমার রাতে বনদুর্গার পুজোয় মাতেন ভক্তরা। এবার রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে এই এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবী তুলেছেন এলাকাবাসী।
কথিত আছে, জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ ব্লকে বৈকুন্ঠপুরের জঙ্গলের ভেতর এই এলাকায় সন্ন্যাসীহাট নামে একটি গ্রামে বাস করা দেশপ্রেমিক সন্ন্যাসীদের নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াই শুরুর আগে ভবানী পাঠককে পাশে নিয়ে দেবী চৌধুরানী এই স্থানে সভা করেছিলেন।
স্থানীয় রাজবংশী মানুষরা পৌষ পূর্ণিমার রাতে এই বনদুর্গার পুজো বহুদিন আগেই শুরু করেন। কিন্তু তখন এটি পরিচিত ছিল ঠুনঠুনির পুজো নামে। গত ৩৭ বছর ধরে এলাকাবাসীরা কমিটি গড়ে বনদুর্গা পুজো নামে ঠুনঠুনির পূজো করে আসছেন। বন্য হাতির হামলা উপেক্ষা করে ফি বছর এক রাতের এই পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। নামে লাখো মানুষের ঢল।
এলাকাবাসী শ্যামল বোস, অমল রায়, দ্বিবেন্দু পাল জানান, "অদ্ভুত এক অনুভূতির টানে প্রতি বছর আমরা এখানে আসি। গভীর রাতে জঙ্গলের ভেতর এসে রাত কাটানোর অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। এই অভিজ্ঞতা নিতে গেলে এখানে অবশ্যই আসতে হবে। তাই আমরা চাই, এই এলাকাকে টুরিজম সার্কিটের সঙ্গে যুক্ত করা হোক।"
গবেষক উমেশ শর্মার কাছে আমাদের প্রশ্ন ছিল, কেন এই এলাকার নাম দিল্লী ভিটা চাঁদের খাল? এই এলাকার সঙ্গে দেবী চৌধুরানীর আদৌ কোনো যোগাযোগ ছিল কি? দুটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, "এক, ভবানী পাঠক ছিলেন উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা। সেই সময় স্থানীয় মানুষেরা উত্তর প্রদেশের বাসিন্দাদের দিল্লী ভিটার বাসিন্দা বলতেন। আসলে বৈকুন্ঠপুরের খরখরিয়া হাট সংলগ্ন নিম নদীর ধারে ঐ এলাকার নাম চাঁদের হাট। সেখানে ভবানী পাঠক থাকতেন, তাই ডাকাতদের সাংকেতিক নাম ধরে এই এলাকাকে বলা হতো দিল্লী ভিটা চাঁদের খাল বলে আমার মনে হয়।"
আর দ্বিতীয় উত্তরটি কী? উমেশবাবুর মতে, "তিস্তাপারের বৈকুন্ঠপুর এলাকার জঙ্গল ও গ্রামে দেবী চৌধুরানীর আসা যাওয়া ছিল। মূলত এখানেই ভবানী পাঠকের একাধিক ডেরার খোঁজ পাওয়া যায়। যেই স্থানে এই পুজো হয়, সেখানে আট রকমের গাছ দিয়ে ঘেরা ভবানী পাঠকের ডেরায় দেবী চৌধুরানী আসতেন। স্যার জে ডি হুকার তাঁর বইতে একথা উল্লেখ করেছেন। পরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'দেবী চৌধুরানী' উপন্যাসেও এই স্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। আমি এই এলাকাটি ঘুরে দেখেছি, এঁদের বর্ণনার সঙ্গে এই স্থানের মিল আছে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, এই এলাকায় দেবী চৌধুরানী এসেছিলেন ও দেশপ্রেমিক সন্ন্যাসী ও ফকিরদের নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সভা করেছিলেন।"