একসময় কাঁসার থালাবাটি ছিল বঙ্গজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হওয়ারই কথা, কারণ বাংলার প্রাচীনতম শিল্পের মধ্যে কাঁসাশিল্প একটি। তবে বর্তমানে প্রশাসনিক সাহায্যের অভাবে, এবং স্টিল, অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে, এই শিল্প ক্রমে বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। এর অন্যতম উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের গড়কমলপুর গ্রামের কথা, যেখানে এই শিল্পের বয়স প্রায় একশো বছর অতিক্রম করেছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার জনপ্রিয়তা অর্জন করে মোঘল আমলে। এসব ধাতু দিয়ে তখন ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক, কামান পর্যন্ত তৈরি করা হত। এরপর ধীরে ধীরে কাঁসা দিয়ে বিভিন্ন দৈনন্দিন নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা শুরু হয়, এবং কাঁসাশিল্প ক্রমে বিস্তার লাভ করে।
আরও পড়ুন: বালি যেন সোনা, অজয়ের বুকে চলছে লুঠের সাম্রাজ্য
কিন্তু মোঘল যুগে যাই হয়ে থাক, মহিষাদলের গড়কমলপুর গ্রামে আজ কার্যত অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমে পড়েছে কাঁসাশিল্প। একসময় এই শিল্প থেকেই এলাকার বহু বাসিন্দা তাঁদের সংসার চালাতেন, তবে বর্তমানে কাঁসার চাহিদা ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় কারিগররা সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন।
স্থানীয় কারিগর মন্টু রাণা জানান, "আমাদের এই শিল্প প্রায় তিন-চার পুরুষ ধরে চলে এসেছে। আগে এখানে একশো থেকে দেড়শো পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তবে বর্তমানে কাঁসার চাহিদা কমে যাওয়ায় সেই সংখ্যা দশ থেকে বারোতে এসে ঠেকেছে। আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, যদি কোন সাহায্য পাই তাহলে খুবই উপকৃত হব।"
সম্পূর্ণভাবে শিল্পীদের নিজেদের হাতে এখানে তৈরি হয় গৃহস্থালির ব্যবহারের থালা, বাটি, গ্লাস, ল্যাম্প, হ্যারিকেন ও পানের সাজা ছাড়াও অনেক কিছু। এখানকার অপর এক প্রবীণা কারিগর সরলা রাণা জানান, "বাজারে এই শিল্পের কিছুটা চাহিদা আছে বলে টিকে আছে, না হলে এই কাঁসাশিল্প আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, অ্যালুমিনিয়াম আর স্টিলের জিনিসের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে মার খেতে হচ্ছে আমাদের এই শিল্পকে।"
তাঁদের আরও অভিযোগ, সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য বারবার আবেদন জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে অনেক কারিগর অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। কয়েক বছর আগেও এই এলাকার প্রতিটি বাড়িতে কাঁসা শিল্পের কাজ হতো, কিন্তু এখন তা বন্ধের পথেই বলা চলে। একসময় মহিষাদলের শিল্পীদের তৈরি কাঁসা, পিতলের জিনিসপত্র প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশাতেও পাঠানো হতো। তবে বর্তমানে সেই বাজারেও স্টিল বা অ্যালুমিনিয়ামের বিভিন্ন সামগ্রী এসে যাওয়ায় কাঁসাশিল্পের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে।
আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রে মুখ উজ্জ্বল বাংলার, শালবনির কৃষকের পায়ে পায়ে
এর একটা বড় কারণ হলো অর্থ। দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় অধিকাংশ বাড়িতেই আজকাল স্টিলের জিনিসপত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। কাঁসা পিতলের চাহিদা বলতে শুধু বিয়েবাড়ি বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাজ। কিন্তু তাও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিয়েবাড়িতেও চাহিদা কমেছে কাঁসা পিতলের তৈরি জিনিসপত্রের। কাঁচা মালের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অনেক শিল্পীরা বাধ্য হয়ে পূর্বপুরুষের ব্যবসা ছেড়ে এখন দিনমজুরি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কাঁসাশিল্পী সোমাশ্রী রাণা জানান, "এই শিল্প নিয়ে সরকারিভাবে যদি কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং আর্থিকভাবে সাহায্য করা হয়, তবে আমরা একে টিকিয়ে রাখতে পারব।" স্থানীয় সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারীর সঙ্গে দেখা করে জেলার ঐতিহ্য ধরে রাখার আবেদন জানান কারিগররা। আবেদনে সাড়া দিয়ে বিডিও-র সাথে যোগাযোগ করার কথা জানান সাংসদ। মহিষাদল ব্লকের বিডিও জয়ন্ত দে বলেন, "স্থানীয় কাঁসা ও পেতল শিল্পীরা তাদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। আমি উপর মহলে পাঠিয়েছি। সমস্যা যাতে দূর করা যায় সেদিকে আমাদের নজর থাকবে।"