/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/04/cats-126.jpg)
ডিজিটাল তাণ্ডবে ‘ছিন্নভিন্ন’ বাংলা ক্যালেন্ডার, হার্ডডিস্কে ‘সুরক্ষিত হিসেবে’ উধাও হালখাতা ট্র্যাডিশন
বাংলা ক্যালেন্ডারেই লুকিয়ে রয়েছে ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন। আর মাত্র কটা দিনের অপেক্ষা, বাঙালি তৈরি নববর্ষকে স্বাগত জানাতে। বাঙালির কাছে নববর্ষ মানেই খানাপিনা, দেদার কেনাকাটা, আড্ডা, নতুন পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে সেরার সেরা জাহির করার পালা। এর বাইরেও নববর্ষের সঙ্গে জড়িত বাঙালির ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির গুরুত্বপূর্ন বাংলা ক্যালেন্ডার ও হালখাতা।
নববর্ষের শুভ মুহূর্ত থেকেই হালখাতার সূচনা হয়। সেই সঙ্গে বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে নববর্ষের রয়েছে এক নিবিড় যোগ। তবে আজকের এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে অনেকটাই মার খেয়েছে বাংলা ক্যালেন্ডারের চল। কলেজ স্ট্রিটের কমবেশি শ’খানেকের বেশি দোকানে কয়েক বছর আগেও এই সময়টাতে নাওয়া- খাওয়ার সময়টুকু মিলত না। এবার কার্যত মাছি মারছেন বিক্রেতারা। “ডিজিটাল এফেক্ট”-এ ফিকে হয়ে গিয়েছে বাঙালি সেই চেনা ট্র্যাডিশন। অনেকেই আবার মনে করছেন স্থানীয় স্তরে বাংলা ক্যালেণ্ডার-হালখাতা তৈরি হওয়ার ফলে কলেজ স্ট্রিটের সেই চেনা ভিড় অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে জানা যায় সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ক বাংলা ক্যালেডারের প্রথম প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে মোঘল সম্রাট আকবর কর আদায়ের সুবিধের জন্য সৌরবর্ষ অনুসারে তারিখ-ই-ইলাহির প্রণয়ন করেন। শকাব্দে বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস ছিল চৈত্র। পরে তা বদলে বৈশাখ থেকে বছর শুরুর প্রথা শুরু হয়। তবে করোনা আবহে দুবছর পর আগামীকাল পয়লা বৈশাখের ভরপুর আনন্দ চেটেপুটে উপভোগ করতে তৈরি আপামোর বাঙালি। গত ২ বছর করোনা আবহে একেবারেই বিক্রিবাট্টা হয়নি ক্যালেন্ডারের। এবার তার তুলনায় কিছুটা ভাল হলেও বাংলা ক্যালেন্ডারের চাহিদা একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/04/cats-127.jpg)
কাগজের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণে খবচ বেড়েছে, ফলে ক্যালেন্ডার বানাতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদে। এদিকে ব্যাবসার হালও বিশেষ ভাল নয়, ‘যারা ৫০০ বা ১০০০ পিস ক্যালেণ্ডার অর্ডার দিতেন তারা এই বছর ২০০ থেকে ৪০০ পিসের অর্ডার দিয়েছেন’। বলছেন কলেজ স্ট্রিটের এক ব্যবসায়ী। প্রথম বাংলা ক্যালেন্ডার ১৮১৮ সালে প্রথম মুদ্রিত আকারে। তার আগে ঐতিহ্যবাহী বাংলা পঞ্জিকাগুলি তাল পাতায় হাতে লেখা হত। বছরের পর বছর বাংলা ক্যালেন্ডার, বাংলা পঞ্জিকা এবং হালখাতা বাঙালির ঐতিহ্য ও সম্প্রীতিকে তুলে ধরত। তবে করোনা কালের পর বাংলা ক্যালেন্ডারের দফারফা অবস্থা।
বড়বাজারের ঐতিহ্যপ্রাচীন মা লক্ষী স্টোর্সের কর্ণধার বাংলা ক্যালেণ্ডারের এহেন দুর্দশা প্রসঙ্গে বলেন, “ডিজিটাল এফেক্ট তো আছেই তার সঙ্গে সমগ্র রাজ্যেই ব্যবসার হাল খুবই খারাপ। বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার প্রভাব যে বাংলার ব্যবসা বাণিজ্যেও পড়েছে তার উদাহরণ পয়লা বৈশাখে বাংলা ক্যালেণ্ডারের শোচনীয় অবস্থা। তিনি বলেন, বাঙালি আগেবপ্রবণ। বাঙালি ঐতিহ্য ও সম্প্রীতিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। করোনা কালীন সময়ের আগেও বাংলা ক্যালেন্ডারের ভালই অর্ডার আসত। নাওয়া খাওয়ার সময় পেত না এখানকার ব্যবসায়ীরা। নোটবন্দী ও করোনা ব্যবসাকে নষ্ট করেছে, তাই অনেকেই আছেন নমো নমো করেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন করছেন। তার সঙ্গে ডিজিটালাইজেশনের এফেক্ট তো রয়েছেই”।
অন্যদিকে বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ – এর সময় থেকেই হালখাতার সূচনা । রাজস্ব আদায়ের জন্যই এই হালখাতার প্রচলন করেন তিনি। এটিকে লাল খাতা কিংবা খেরো খাতাও বলা হয়। নতুন বছরে খাতার প্রথম পাতায় লাল সিঁদুরের স্বস্তিক চিহ্ন একেই সূচনা করা হয় নতুন খাতা কিংবা হালখাতার। আবার অনেকেই বলেন সম্রাট আকবরের সঙ্গেই সম্পর্কিত এই হালখাতার উৎসব। তার নির্দেশ অনুযায়ীই নাকি নতুন বছরের প্রথম দিন ফসল কর আদায় কিংবা রাজস্ব আদায় হিসেবে শনাক্ত করা হয়। হিন্দু সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা এবং ইসলামি চন্দ্রমাস হিজরী সালের সমন্বয়েই মুঘল রাজ জ্যোতির্বিদ এই দিনটিকে নির্দিষ্ট করেছিলেন – তারপর থেকেই এইদিন হালখাতা উৎসব অথবা তৎকালীন সমাজে পুণ্যহ বলে পরিচিত ছিল।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/04/cats-128.jpg)
হালখাতা হল পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত একটি উৎসব যেখানে গত বছরের সমস্ত হিসেব-নিকেশ শেষ হয়। ও সেই দিন থেকেই একটি নতুন খাতা খোলা হয়। বাঙালি ব্যবসায়ী, দোকানদারেরা এই নতুন খাতা খোলেন মিষ্টিমুখ, পুজোর মাধ্যমে। বাংলা ক্যালেণ্ডারের সঙ্গেও মার খেয়েছে হালখাতা ব্যবসাতেও। তবে গত বছরের থেকে পরিস্থিতি কিছুটা ভাল বলছেন কলেজ স্ট্রিটের ব্যবসায়ীরা। এক সময় কলেজস্ট্রিট, বৈঠকখানা বাজারে হালখাতা কিনতে পড়ত বিরাট লাইন।
ডিজিটালাইজেশনের এফেক্ট এখন তা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কেই বন্দী। তাও চেনা লাইন না থাকলেও টুকটাক সারাদিন কেনাবেচা চলছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ‘কোভিড কালে ক্ষত সামলে ধীরে ধীরে চাঙ্গা হতে শুরু করেছে বাজার। সময় তো লাগবেই। আর্থিক ক্ষতি সামলে গত ২ বছর অনেকেই হালখাতা, ক্যালেণ্ডারের ঝক্কি রাখেন নি। তবে এবার ধীরে ধীরে বাঙালি আবার তার ঐতিহ্যে ফেরার চেষ্টা করছে নতুন আশা নিয়ে নতুন বছর সেলিব্রেশনে মাততে তৈরি আপামোর বাঙালি’।