রাত পোহালেই পয়লা বৈশাখ! বর্ষবরণের আনন্দে গা ভাসাতে প্রস্তুত আট থেকে আশি সকলেই। পয়লা বৈশাখের সোনালী সেই দিনগুলো স্মৃতির চিলেকোঠায় আজও যেন অমলিন হয়ে রয়ে গিয়েছে। পয়লা বৈশাখ মানেই ষোল আনা বাঙালিয়ানা। আর বাংলা-বাঙালি যেখানে সেখানে আড্ডা বা জলসা থাকবে না এ যেন কল্পনাই করা যায় না।
পয়লা বৈশাখের সঙ্গে যেমন বাংলা তথা বাঙালির রীতি, ঐতিহ্য, পরম্পরার যেন এক প্রাচীন সম্পর্ক। হালখাতা হোক অথবা বাংলা ক্যালেণ্ডার…! আপামোর বাঙালির কাছে পয়লা বৈশাখ মানেই জলসা, গান বাজনার আসর। এই রীতি যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে বাঙালির রক্তের সঙ্গে। বৈশাখের জলসা আর বসুশ্রী হলের মধ্যে যোগসূত্রটা দীর্ঘদিনের। বছরের প্রথম দিনে জলসা দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন হাজারে হাজারে মানুষ। শুধু কী বাংলা? এই জলসার সাক্ষী থাকতে ভিন রাজ্য থেকেও মানুষজন ভিড় করত বসুশ্রী হলে।
টিকিটের বালাই ছিল না বললেই চলে। তাই জলসা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তা হাউসফুল হত বৈকি! আর এই জলসায় অংশ নিতেন তাবড় তাবড় গুণী শিপ্লীরা। কে নেই সেই তালিকায়! শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এমনকী লতা মঙ্গেশকর, সূচিত্রা সেনও অংশ নেন সেই জলসায়। আর জলসার প্রাণপুরুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যার একান্ত প্রচেষ্টাতেই শুরু হয় বসুশ্রী’র জলসা।
সেদিনের সেই জলসা বসুশ্রীর হলের পরিবেশটাকেই এক কথায় বদলে দিত। গুণী শিল্পীরাও সেই জলসার জন্য নিজেদের তৈরি করতেন অনেক দিন থেকেই। কলকাতায় থাকলে আসতেন কিশোর কুমারও। সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো ছিলেনই। এমনকি মহানায়ক উত্তম কুমারও বেশ কয়েক বার সেই জলসায় হাজির হয়েছিলেন। বসুশ্রীর কর্ণধার ছিলেন মন্টু বসু। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে প্রতিবছর বৈশাখের সকালে বসত জলসা। এই জলসায় একবার নিজের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শ্রোতাদের মন জুড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং মহানায়ক উত্তম কুমার।
১৯৮০-তে উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পরেও এই জলসা থেমে থাকেনি৷ তবে ১৯৮৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মারা যাওয়ার পর আর এই জলসা চালিয়ে যেতে চাননি বসুশ্রীর কর্ণধার মন্টু বসু। ১৯৭৮ সাল থেকে জলসার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তোচন ঘোষ। ২০১৪ সালের পয়লা বৈশাখের পর ঠিক পরপর মারা যান মন্টু বসু।
জলসা সামলানোর দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে তোচন বাবু। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি পয়লা বৈশাখের জলসা চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে। এবারও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বসুশ্রী হলে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর নেই, নেই মহানায়ক উত্তম কুমার, কিন্তু বসুশ্রী হল তো রয়েছে। রয়ে গিয়েছে হলের সঙ্গে বাঙালির আবেগ, নস্ট্যালজিয়া।
তোচন ঘোষ বলেন, ‘পয়লা বৈশাখের বিশেষ এই দিনে আমরা সেই পুরনো ঐতিহ্য, বাঙালির আবেগের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে এই বছর পয়লা বৈশাখে আয়োজিত করতে চলেছি, বসুশ্রীর পয়লা বৈশাখ! অনুষ্ঠান শুরু হবে ঠিক সকাল দশটায়। এবারের পয়লা বৈশাখে প্রবাদ প্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও বসুশ্রীর কর্ণধার মন্টু বসু স্মরণে আয়োজন হতে চলেছে বিশেষ অনুষ্ঠানের। হাজির থাকবেন উষা উত্থুপ, বাবুল সুপ্রিয়, হৈমন্তী শুল্কা, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, জোজো, রঞ্জিত মল্লিক, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, মনোময় সহ একঝাঁক কলাকূশলীরা’। তিনি বলেন, ‘অতীতের দিনগুলো স্মৃতির পাতায় আজও অমলিন! বসুশ্রী’র এই জলসা ছাড়া যেন পয়লা বৈশাখ আজও সম্পুর্ণ নয়। পয়লা বৈশাখ মানেই বসুশ্রী হলের জলসা’।