রাজ্যে অবাধে 'অপরাধের কুটির শিল্প' বাড়বাড়ন্ত রীতিমত আতঙ্ক তৈরি করেছে। উত্তর ২৪ পরগণার কাঁকিনাড়া থেকে মালদা বোমার আঘাতে একের পর এক শিশুমৃত্যু ও আহতের পরিসংখ্যান হাড়ে কাঁপুনি ধরাবে।
বিজেপি দাবি করেছে যে ২০১৮ সাল থেকে বোমা হামলায় তাদের ২২৪ জন সমর্থক নিহত হয়েছেন, সিপিএম গত দুই বছরে তাদের ১৫ জন কর্মীর নিহতের দাবি করেছে। তবে টিএমসি স্রেফ এটিকে প্রচার হিসাবে উড়িয়ে দিয়েছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে এগরা বাজি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৯টি তাজা প্রাণ ঝলসে যাওয়ার ঘটনায় NIA তদন্তের দাবি জানিয়েছে বিজেপি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনৈতিক মহলে নতুন করে ঝড় উঠতে শুরু করেছে।
যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার NIA তদন্তে সরকারের কোন আপত্তি নেই বলেও সাফ জানিয়েছেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তদন্তে দেখেছে মাত্র এক বছরে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পাঁচটি জেলা জুড়ে বোমার আঘাতে ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং ১৮ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। এমন ২৪ টি পরিবারকে খুঁজে বের করেছে। জেলাগুলির মধ্যে রয়েছে বর্ধমান, বীরভূম, মালদা, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
বোমার আঘাতে শিশুমৃত্যু প্রসঙ্গে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কমিশনার অলোক রাজোরিয়ার জানিয়েছেন, " আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। তবে শুধু অভিযানই নয় আমরা শিশু ও তাদের পরিবারকে সতর্ক করছি । স্কুল ও পাবলিক প্লেসে প্রচার জোরদার করছি । রাস্তা বা আবর্জনা থেকে কোন সন্দেহজনক বস্তু না তোলার বিষয়ে বারেবারে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।"
রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একে অপরের ওপর দোষারোপের পালা চলছে।
বাংলা জুড়ে বোমার আঘাতে শিশুমৃত্যু ঠেকানোর পথে প্রধান বাঁধা নিহত বা পঙ্গু শিশুর প্রকৃত সংখ্যার অভাব। কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটসের চেয়ারপারসন সুদেষ্ণা রায় এপ্রসঙ্গে বলেছেন, “আমরা প্রতিটি ঘটনাকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বিবেচনা করি এবং পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিই। প্রয়োজনে আমরা ডিজিপি এবং রাজ্য সরকারের কাছে ঘটনা ফলোআপ করি এবং চিঠি দিই। যদি কোন বড় ঘটনা ঘটে, আমরা তদন্ত করে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য একটি দল পাঠাই"।
তবে মৃত বা আহত শিশুর সঠিক সংখ্যার তথ্য কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটসের তরফে মেলেনি। ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস জানিয়েছে, "এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যেখানে শিশু মারা গেছে বা পঙ্গু হয়েছে, তবুও তাদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি"।
NCPCR চেয়ারপারসন প্রিয়াঙ্ক কানুনগো বলেছেন, " কমিশন সিপিসিআর আইনের ১৫ নং ধারার অধীনে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করতে পারে। প্রতিবন্ধকতা যে ক্ষেত্রে তা হল রাজ্য কমিশন আমাদের ঘটনা প্রসঙ্গে জানায় যে তারা বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করছে, ক্ষতিপুরণ পাওয়ার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়'।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাথে কথা বলার সময়, মহিলা ও শিশু কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শশী পাঁজা বলেছেন "কোনও সন্দেহ নেই যে কোনও ধরণের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা অবাঞ্ছিত এবং দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এতই স্পষ্টবাদী যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে পুলিশকে অভিযান চালাতে এবং রাজ্যের যে কোনও জায়গায় লুকানো সমস্ত বোমা এবং অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করতে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছেন। কারা, কেন এবং কী উদ্দেশ্যে এই ধরনের বোমা মজুদ করা হয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হবে।” বোমার আঘাতে শিশু মৃত্যু ও আঘাতের টিএমসির মুখপাত্র জয়প্রকাশ মজুমদার এই ধরনের ঘটনাকে "জঘন্য এবং ষড়যন্ত্রের ঘটনা বলে উল্লেখ করে বলেন, বাংলার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এই ধরণের জঘন্য ঘটনা ঘটানো হচ্ছে"।
বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য বলেছেন, “এখানে-ওখানে বোমা মজুত করা হচ্ছে এবং খেলতে গিয়ে শিশুরা মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় হল প্রশাসনের এ ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা নেই। আগে বিহারের মুঙ্গের থেকে পশ্চিমবঙ্গে অস্ত্র আসত, কিন্তু এখন এখানেই তৈরি হচ্ছে।” সিপিআই(এম) এর সুজন চক্রবর্তী বলেছেন যে টিএমসি "অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে। জনগণের অর্থ লুট হচ্ছে।" এই ধরণের পরিস্থিতিতে, এমন ঘটনা ঘটবে তা খুবই স্বাভাবিক"।
গত মাসে, বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী রাজ্যে রাম নবমীতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের NIA তদন্ত চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেন। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা অবনতির কথা উল্লেখ করে বিরোধী দলনেতা যুক্তি দিয়েছিলেন যে রামনবমী সংঘর্ষের সময় যথেচ্ছ বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল। আদালত, ইতিমধ্যেই এনআইএ-র কাছে তদন্ত হস্তান্তর করেছে। বিস্ফোরক পদার্থ আইনে রাজ্য পুলিশের ব্যর্থতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।