অন্ধত্ব থামাতে পারেনি সবিতার লড়াইকে। হাজারো বাঁধা অতিক্রম করে তিনি বর্তমানে তিনি হয়ে উঠেছেন সমাজের এক আইকন। অনেকের কাছেই তিনি আজ অনুপ্রেরণা।
সাধারণ এক কিশোরী থেকে 'অসাধারণ যুবতী' হয়ে ওঠার এই কাহিনী চমকে দেবে আপনাকেও। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিলেন সবিতা হালদার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মুহূর্তেই জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের সঙ্গে চলে দীর্ঘ লড়াই। অবশেষে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ে একশোয় ১০০ পেয়ে পাস করলেন মছলন্দপুরের শক্তিনগরের সবিতা হালদার। সমাজে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে যারা নানান প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে জীবনে সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন। সবিতাও তাদের মধ্য অন্যতম। হাজারো চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে সবিতা আজ হয়ে উঠেছেন লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা ।
যুবকের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় জোটে কঠিন শাস্তি। যার জেরে দৃষ্টিশক্তি হারাতে হয় সবিতাকে। উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরের শক্তিনগরের বাসিন্দা সবিতা। স্থানীয় ভূদেব স্মৃতি গার্লস স্কুল থেকে তার মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় এক যুবকের প্রেমের প্রস্তাব ফেরান সবিতা। সেই রাগে প্রতিবেশী ওই যুবক তাকে প্রতিশোধ নিতে হঠাৎ করেই একদিন সবিতার ঘরে ঢুকে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবিতার চোখে বালি ছুঁড়ে দেয়, এরপর দুচোখে পেরেক বিঁধে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বছর ১৭-এর সবিতা। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে প্রথমদিকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। কীভাবে চলবে পড়াশুনা? কীভাবে হবে স্বপ্নপূরণ? এই ভেবেই দিন কেটে যায় তার। এদিকে মেয়ে্র চোখের দৃষ্টি ফেরাতে করতে হন্যে হয়ে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ান তার বাবা-মা। চিকিৎসার জন্য অনেক জায়গায় গেলেও ফল কিছুই হয়নি। চিকিৎসকরা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মেয়ের হারানো দৃষ্টিশক্তি কখনই ফেরেনাও সম্ভব নয়। একথা শুনে ডুকরে কেঁদে ওঠেন সবিতা।
শুরু হয় চোয়াল শক্ত করে লড়াইয়েই দ্বিতীয় অধ্যায়। অন্ধত্বের কাছে আর মাথা নত না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে লড়াইয়ে নেমে পড়ে সেদিনের সেই ছোট মেয়েটা। সবিতার বাবা মন্মথ হালদার পেশায় একজন সবজি বিক্রেতা এবং তার মা গৃহবধূ। ঘটনার পর পরিবারে নেমে আসে চরম আর্থিক সঙ্কট। সবিতার দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে সঞ্চয়ে হাত পড়ে মন্মথ হালদারের। অনেক বাধা সত্ত্বেও রেলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সবিতা। হাওড়া স্টেশনে যাত্রীদের পথ দেখাতে পাবলিক অ্যাড্রেসে ঘোষকের ভূমিকায় চাকরি মেলে দৃষ্টিহীন এই মেয়ে সবিতার। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীকে পথ বলে দেন এই অন্ধ ঘোষক।
নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে সবিতা তার মায়ের সঙ্গে ট্রেনে ধরে হাওড়া স্টেশন অফিসে আসেন। মোবাইল অ্যালার্ট শুনে, জটিল ব্রেইল পদ্ধতি রপ্ত করে অফিসের সব কাজ নিজের হাতে সামাল দেন এই দৃষ্টিহীন ঘোষক। বাড়িতে রয়েছেন বাবা-মা-ভাই-ভাইয়ের স্ত্রী। সবিতার চাকরি কিছুটা হলেও দিশা দেখিয়েছে এই হত দরিদ্র পরিবারকে। আর দৃষ্টিহীন সবিতার লড়াই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন লাখো মানুষকে।
বাবা-মা মেয়েকে নিয়ে রীতিমত গর্বিত। তাঁরা বলেছেন, “তার অসীম সাহস এবং দৃঢ় সংকল্প আজ সবিতাকে তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করেছে। স্কুলে বরাবরই ভাল ছাত্রী হিসাবে পরিচিত ছিল সে। আমাদের অনেক আশা ছিল যে একদিন ও বড় অফিসে চাকরি করবে। আজ ও চোখে দেখতে না পেলেও ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে লক্ষ্য অর্জন করেছে"।