দেবতা-অসুর সবাই থাকেন এখানে এক সঙ্গে।
এখানে সকালে উঠে সাজঘরে ঢুকে মুখে রঙ মেখে হাতে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে না পড়লে দিন ভর অভুক্ত থাকতে হয়। এ গ্রামে পড়ুয়ারা ভোর হলেই ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যায়।
এ গ্রামের মানুষরা বছরের প্রতিটি দিন রঙ মেখে জীবন কাটালেও শুধু ভোটের দিন আসল চেহারা আর ভোটের কার্ড নিয়ে ভোটের লাইনে দাঁড়ান।
গ্রামের নাম ভালকুঠি বিষয়পুর, থানা লাভপুর, জেলা বীরভূম।
বহু বছর আগে গুজরাটের একদল শিকারী নিজেদের ঠিকানা খুঁজতে নানা প্রান্ত ঘুরে বীরভূমের এই অঞ্চলে আসেন, তখন এ জায়গা ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। সেখানেই বসতি গড়েন তাঁরা। সময়ের সঙ্গে জঙ্গল গেছে হারিয়ে, গ্রাম বসতি হয়েছে। শিকারীরা তাঁদের আদি পেশা ছেড়ে বহুরূপীর পেশাকেই জীবিকার মাধ্যম করে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের উপাধি থেকে গেছে ব্যাধ।
আরও পড়ুন, এক্কাগাড়ির দৌড় শেষ মুর্শিদাবাদে
কত বছর ধরে তাঁরা এ পেশায় যুক্ত?
কেউ বলেন ঠাকুর্দার মুখে শুনেছেন তাঁর বহুরূপী জীবনের কথা। কিন্তু একসময়ে প্রায় শতাধিক পরিবারের এই পেশার সংখ্যা কমে গেছে। এখন বিষয়পুরে ৫০ টির মতন পরিবার এই পেশায় যুক্ত।
সবই প্রায় কুঁড়ে ঘর, একটা ঘর রঙের আলপনা দিয়ে সাজানো। সেটা সাজঘর। সকলের সাজঘর।
সেখানে সকালে রূপচর্চার পালা সেরে দলে দলে তারা রওনা দিয়ে দেন শহরের দিকে। কেউ ট্রেনে-বাসে পথচলতি যাত্রীদের মনোরঞ্জন করেন, কেউ বা অন্য কোথাও।
এক বছর পঁচিশের মহিলাকে বহু বছর ধরেই শিশু কোলে ট্রেনে ঘুরতে দেখা যায়। সে শিশুদের নানা রূপ। তিনি জানালেন, তাঁর সব সন্তানেরাই বহুরূপী সেজে রোজগার করেন, তাতেই তাঁর সংসার চলে। জানা গেল, মা তারা এক্সপ্রেস ট্রেনে মা তারার রূপ ধরলে যাত্রীরা খালি হাতে ফেরান না সাধারণত। ধর্মীয় উৎসবের সময় বুঝে সেই রূপ ধারণ করলে রোজগার কিঞ্চিৎ বেশি বলেই জানাচ্ছে অভিজ্ঞতা।
দৈনিক গড় আয় ২০০ টাকা। এ বাজারে এই রোজগারে জীবনধারণ করা প্রায় অসম্ভব। তবু তাঁরা অন্য় পেশায় যেতে নারাজ। ভিক্ষাবৃত্তি তো নৈব নৈব চ।
এক প্রবীণ বহুরূপী বললেন, শহরের পাড়ায় গিয়ে বাচ্চাদের হুল্লোড়ের মাঝে পড়ে হইচই করতে করতেই এক একটা দিন চলে যায়, তাদের বাড়ি থেকে পাঁচ দশ টাকা দিল হয়ত, কেউবা কপালে হাত ঠেকিয়েই বিদায় করে দিল। তাই বলে মন খারাপ করে বসে থাকলে চলে না। পরদিন ফের বেরোতে হয়। আমাদের ব্যাধের রক্ত, ছুটে বাঁচি আমরা।
সরকারি ভাবে কয়েক জন বহুরূপী শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছেন। প্রায় ১৫ বছর আগে বীরভূমের প্রয়াত শিক্ষাবিদ গবেষক অরুণ চৌধুরী উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই সম্প্রদায়ের মানুষদের মূল স্রোতে এনে শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর করার। তাঁর সেই প্রচেষ্টা আংশিক হলেও সফল হয়েছে। বাণী ব্যাধ নামে এক কিশোরী স্কুল শেষ করে প্রথম ব্যাধ সম্প্রদায়ের মধ্যে মাধ্যমিক উত্তীর্ণা হয়ে এখন অঙ্গনওয়াড়ির কাজ করছে। বাণীকে দেখে উজ্জীবিত হয়ে বিশ্বজিত ব্যাধ ও খোকন ব্যাধ নামে দুই বহুরপী গত বছর মাধ্যমিক পাশ করেছে। কিন্তু জীবিকার কোন পথ না পেয়ে সেই বহুরুপীর পেশাতেই ফিরে গেছে তারা।
বিষয়পুরের কাছে শিল্পীগ্রাম গড়ার পরিকল্পনা থাকলেও তার রূপায়ণ হয়নি আজও। বিষয়পুরের সূমিত্রা ব্যাধ এবং চুমকি ব্যাধের আক্ষেপ এখনও তাঁরা সরকারি পরিচয়পত্রও পাননি।
তারা ব্যাধ এখন চেষ্টা করেন বড় শহরে যোগাযোগ করে বড় পুজো বা কোনও অনুষ্ঠানে কাজ করার, তাঁর কথায় এসব কাজে অনেক বেশি টাকা। তবে কি বহুরূপীরা কি শেষে সঙ সাজবে? এ সকলে তেমন চাইছেন না।
যাঁরা বয়সের ভারে কাজ করতে পারেন না তাঁদের সমস্যা দুর্বিসহ। সরকারী বার্ধক্য ভাতা মিললে হাতে চাঁদ পান তাঁরা। এই পেশা থেকে সম্পন্ন হতে পেরেছেন তেমন মানুষরা সংখ্যায় অতি কম। তাঁরা কেউই প্রায় পুরনো পেশায় নেই, তেমন কেউ কেউ গ্রামও ছেড়েছেন। তবে সব বদলালেও নিজেদের ব্যাধ উপাধি তাঁরাও বদলাননি।
রাত ৮ টার পরে সবাই ঘরে ফেরেন। কেউ গিয়েছিলেন আসানসোলে, কেউ রামপুরহাটে, কেউ সিউড়ি বাজারে তো কেউ বোলপুর শহরে। পোষাক বদলে পুকুরের জলে মুখের রঙ ধুয়ে উনুনে আগুন জ্বলে, শুরু হয় সারা দিনের গল্প। গ্রাম শহরের কুকুরের পাল যেভাবে তাদের রূপ আর অভিনয় দেখলে তাড়া করে তখন কোনও মানুষ তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেন না, অভিমান তাঁদের। এমনকি কোথাও চুরি হলেও মানুষ ভাবে বহুরূপী ব্যাধরা বুঝি সে দলে আছেন। এসব সুখ দুখের কথা বলতে বলতে রাতের খাবার শেষ। পরদিন আবার সেই পুরনো জীবনযাপন, আগের দিনের মতই।
শিশু শ্রমিকের ব্যবহারের সরকারি নিষেধাজ্ঞাটা কাগজ কলমেই থাক, বিষয়পুরের বহুরূপীরা বলেন সরকার কিছু দিতে না পারুক কিছু কেড়ে যেন না নেয়।
গবেষকরা তাঁদের বলেন রূপতাপস। কিন্তু গালভরা নামের আড়ালে জীবন যন্ত্রণা যে ঠিক কেমন, তা শরৎচন্দ্রের শ্রীনাথ বহুরূপী থেকে একালের বিষয়পুরের বহুরূপীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তবু ব্যাধ উপাধি তারা ছাড়বেন না, এতেই রয়েছে তাঁদের পরম্পরা।
বলা বাহুল্য, উপাধিই তাঁদের পদবী।