Advertisment

যাদবপুরের ফুটপাথের হকার লিখে ফেললেন সুন্দরবনের ইতিহাস

যাদবপুরের ফুটপাথে বই বিক্রির ফাঁকে এই হকার লিখে ফেলেছেন সুন্দরবনের ক্যানিং অঞ্চলের ইতিহাস। গবেষক মহলে আদৃত হয়েছে তাঁর বই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

গবেষক, বইবিক্রেতা, সাহিত্যকর্মী পূণ্যবাবু। ছবি: অর্ক ভাদুড়ি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটের সামনের ফুটপাথ। সারি সারি খাবার দোকান, মোবাইল মেরামতির দোকান, ফলের দোকান। তার মধ্যেই চোখে পড়বে একটি পুরনো বইয়ের দোকান। দোকান সামলাচ্ছেন মধ্য পঞ্চাশের এক ব্যক্তি। নাম পূর্ণেন্দু ঘোষ। ডাকনাম পুণ্য। তবে তাঁর অন্য পরিচয়ও রয়েছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করার ফাঁকেই তিনি লিখে ফেলেছেন সুন্দরবনের একাংশের ইতিহাস! সেই বই আদৃত হয়েছে গবেষক মহলে। তা ছাড়াও আরও একাধিক বই-এর লেখক যাদবপুরের ফুটপাথের এই ব্যবসায়ী, যাঁর প্রথাগত পড়াশোনা কলেজের গণ্ডি ডিঙোয়নি।

Advertisment

পুণ্যবাবুর জন্ম ক্যানিং থানার অর্ন্তগত এক নম্বর পূর্বদিঘির পাড় গ্রামে। গ্রামের পাশেই মাতলা নদী। নদীর ধারে আদিবাসীদের বাস। পুণ্যবাবুদের পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বালিতে। তাঁর কথায়, "পোর্ট ক্যানিং যখন তৈরি হল, তখনই আমাদের পরিবার এই এলাকায় চলে আসে। মোটামুটি সচ্ছল অবস্থাই ছিল, কিন্তু ১৯৪৩ সালের বন্যায় আমাদের ভদ্রাসন মাতলার গ্রাসে চলে যায়। তারপর থেকেই আর্থিক অনটন নিত্যসঙ্গী। আমার সারাজীবনেও সেই অনটন আর কাটেনি। বলতে পারেন দারিদ্র আমার জন্মদাগ," হেসে ফেলেন পুণ্যবাবু।

আরও পড়ুন: কেন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদে ফুঁসছে ঝাড়খণ্ডের এই গ্রাম?

বাবা ছিলেন তালাচাবির মিস্ত্রি। প্রবল দারিদ্র নিত্যসঙ্গী, কিন্তু আড়বাঁশি বাজানোর নেশা ছিল। যাত্রাপালায় বাঁশি বাজাতেন নিয়মিত। সেই থেকে পুণ্যবাবুর মগজেও সাহিত্য, সংস্কৃতি, আঁকাআঁকির ভূত ঢুকে যায়। তাঁর কথায়, "ছাত্র খুব খারাপ ছিলাম না। কিন্তু স্কুলের পরে পড়াশোনা আর তেমন হল না। স্থানীয় স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। কিন্তু প্রবল অর্থকষ্ট! ডিগ্রিটা শেষ করতে পারলাম না।" চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে পুণ্যবাবু বলতে থাকেন, "সংসারে অর্থ দিতে হত। তাই উপার্জন শুরু করলাম। বিচিত্র সব কাজ। কিন্তু ছোট থেকেই লিখতে ভালবাসতাম তো, তাই লেখাটা কখনও ছাড়িনি। সারাদিনের পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে লিখতে বসতাম। লিখতে লিখতে রাত ভোর হয়ে যেত। ঘুম হত না দিনের পর দিন। তবুও লিখে যেতাম। লেখাই ছিল আশ্রয়। লেখাই ছিল শান্তি। লেখা ভুলিয়ে দিত খিদে, ভুলিয়ে দিত অভাব।"

বই-এর ব্যবসা শুরু করার আগে কী করতেন? পুণ্য বলেন, "কী যে করিনি তাই ভাবি। রেলস্টেশনে, ট্রেনে হকারি করেছি। সাইনবোর্ড লিখেছি। মাটির প্রতিমা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেছি। ছোটপত্রিকায় কাজ করেছি। হোটেলে থালা-বাসন মেজেছি। গত দেড় দশক রাস্তায় বই বিক্রি করি।" আর লেখালিখি? "এ-সব করার ফাঁকে ফাঁকেই লিখে গিয়েছি একটানা, বিরতিহীন। প্রথমে দেওয়াল পত্রিকায় লিখতাম, তারপর বিভিন্ন ছোটপত্রিকায়। একবার বাংলার প্রথমসারির একটি সাময়িকপত্রে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। সেই সূত্রেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, আবুল বাশারের মতো সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তবে ওঁরা অনেক দূরের গ্রহ। অনেকের মতো আমারও প্রেরণা।"

sunderbans history jadavpur hawker নিজের দোকানে পুণ্যবাবু। ছবি: অর্ক ভাদুড়ি

পুণ্যবাবুর প্রথম বইয়ের নাম 'রাখালবন্দনা'। ১২টি গল্পের একটি সংকলন। এরপর লেখেন কিশোরদের জন্য গল্পচ্ছলে কলকাতার ইতিহাস। নাম, 'গল্পকথায় কলকাতা'। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই 'ইতিহাসের আলোকে সুন্দরবন ও পোর্ট ক্যানিং'। কেবলমাত্র ক্যানিং নয়, গবেষণাধর্মী এই বইতে পূ্ণ্যবাবু সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অংশের জনবসতি গড়ে ওঠার ইতিহাস লিখেছেন। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইটি গবেষক মহলেও সমাদৃত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অর্জুন নস্করের কথায়, "অসামান্য কাজ। একজন ফুটপাথের বই বিক্রেতা বিপুল তথ্যসমৃদ্ধ, অথচ অত্যন্ত সুপাঠ্য যে বইটি লিখেছেন, তা লিখতে পারলে অনেক অধ্যাপক, গবেষকই গর্ববোধ করতেন। যে পরিমাণ গবেষণা উনি করেছেন, আমরা অনেকেই তা পারি না।"

পুণ্যবাবু জানান, ওই বইটি তাঁর গত ২০ বছরের পরিশ্রমের ফসল। তাঁর কথায়, "আমি তো দিন আনি, দিন খাই। সংসার চালানোর জন্য রোজ উপার্জন করতে বেরোতে হয়। কিন্তু তার মাঝেই সুন্দরবনের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে বেরিয়েছি। দিনের পর দিন হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছি গ্রন্থাগার আর মহাফেজখানায়। তাতে হয়তো সবদিন ভাত জোটে নি, কিন্তু তৃপ্তি পেয়েছি অসীম।"

আরও পড়ুন: প্রায় তিন দশক ধরে ২৫ পয়সায় কচুরি মেলে এখানে

ফুটপাথে বই বিক্রি করে লেখালিখি চালাতে সমস্যা হয় না? প্রশ্নটাকে হেসে উড়িয়ে দিলেন পুণ্যবাবু। "কীসের সমস্যা! আমি তো নাম, যশ কিছুই চাই না। লিখে শান্তি পেতে চাই শুধু। সেটা ঠিক পেয়ে যাই। এই যে সারাদিনের পরিশ্রম, অপমান, ক্লান্তি - সব ভুলিয়ে দেয় লেখা। আর আমার যে কোনও লেখার প্রথম শ্রোতা হলো আমার স্ত্রী রেখা। ও পড়াশোনা খুব একটা করেনি, কিন্তু আমার লেখা ওর চেয়ে ভাল আর কেউ বোঝে না। যতদিন আমার লেখা ওকে আনন্দ দিতে পারছে, আমার কলম সার্থক।"

নির্বাচনের আগে বিক্রিবাটা কম। কথাবার্তার ফাঁকেই ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পুণ্য। হেসে বললেন, "রেখার দুরারোগ্য কিডনির অসুখ। টাকার জন্য ভাল করে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আরও বেশি বই বিক্রি করতে হবে এ-মাসে।" রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। পথচলতি দু-একজন উঁকি দিচ্ছেন পুরোনো বইগুলির দিকে। কলকাতার ব্যস্ত ফুটপাথে ফের বই বেচতে শুরু করলেন লেখক, গবেষক, সাহিত্যকর্মী পূর্ণেন্দু ঘোষ।

kolkata
Advertisment