দেশ সেই সময়ে ছিল পরাধীন। বিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতায় দেশ জুড়ে তখন চলছে গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন। দেশ স্বাধীন করার সংকল্প নিয়ে বিপ্লবীরা জীবন বাজি রেখে সেই লড়াই আন্দোলনে নেমে পড়েছিলেন। সেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ আছড়ে পড়েছিল পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার গোপালপুর গ্রামে। সেই বৈপ্লবিক যুগ সন্ধিক্ষনেই অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়। বিদেশি সংস্কৃতি ও ভাবধারা পরিহার করে স্বদেশী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিদ্যালয়ে আজও রবিবার চালু থাকে পঠনপাঠন। সোমবার পূর্ণ দিবস ছুটি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যালয়ের ধারা পাল্টায়নি।
প্রতিষ্ঠাতার দেশ প্রীতির ভাবনাকে মান্যতা দিয়ে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় আজও প্রতিষ্ঠা কালের নিয়ম মেনেই চলছে বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ পার হয়ে যাবার পরেও প্রতিষ্ঠাতার সম্মানার্থে এই নিয়মের কোন পরিবর্তন আনতে চান না বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। স্বাতন্ত্র ভাবধারায় তাই গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় এই রাজ্যের 'হেরিটেজ' বিদ্যালয় হিসাবে পরিচিতি অর্জন করেছে।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সমীর কুমার ঘোষাল বর্তমানে এই বিদ্যালয়েরই শিক্ষক। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'গোপালপুর গ্রাম প্রাক স্বাধীনতা যুগে অশিক্ষা এবং অনুন্নয়নের অন্ধকারে ঢাকা ছিল। শিক্ষা লাভের জন্য গ্রামে ন্যূতম একটা পাঠাশালা পর্যন্ত ছিল না। গোপালপুর গ্রাম নিবাসি দেশপ্রেমিক অবিনাশ চন্দ্র হালদার দেশীয় ভাষায় নিজের গ্রামের মানুষজনকে শিক্ষার আলোকে আনার সংকল্প গ্রহন করেন। তিনি নিজের জমিতেই বিদ্যালয় গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। খেজুর গাছের কাটা গোড়া, বাঁশ ও খড় দিয়ে অবিনাশবাবু তৈরি করে ফেলেন একটি আটচালা। ১৯২২ সালের ৫ জানুয়ারি সেখানেই শুরু হয় পঠন-পাঠন। নিজের আরাধ্য দেবী মুক্তকেশী স্মরনে অবিনাশ হালদার নিজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের নাম রাখেন গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়।
সমীর ঘোষাল আরও জানান,দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বিদ্যালয় গড়ে উঠলেও ইংরেজী পঠনপাঠন না থাকায় তদানিন্তন সময়ে এই বিদ্যালয়টিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তাতে দমে জাননি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম দিকে বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। তবুও হাল ছাড়েননি অবিনাশবাবু। এই সময় তাঁর মহতি উদ্যোগ সফল করতে পাশে দাঁড়ান গ্রামেরই রাজবল্লভ কুমার, বিজয়কৃষ্ণ কুমার, ভূষণচন্দ্র হালদাররা। এই সকল ব্যক্তিদের সম্মিলিত আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছু কিছু অভিবাবক তাঁদের সন্তানদের এই বিদ্যালয়ে পড়াতে পাঠানো শুরু করেন। হালদার মহাশয় নিজের হাতে রান্না করে বিদ্যালয়ে পড়তে আসা পড়ুয়াদের খাওয়াতেন।
এতকিছুর পরেও এলাকায় শিক্ষিত লোক কম থাকায় তদানিন্তন সময়ে বিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য শিক্ষক খুঁজে পাওয়া দুরহ হয়ে উঠেছিল। অবশেষে স্থানীয় নুদীপুর গ্রাম নিবাসি শিক্ষাবিদ ভূপেন্দ্রনাথ নায়েক এই বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়ানোর ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন। নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি আমৃত্যু এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তারপর ক্রমে বিদ্যালয়ে পড়ুয়া সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর বিদ্যালয় চালানোর জন্য অর্থ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে শুরু করেন গ্রামেরই বহু মানুষ।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও পরিচালন কমিটির প্রাক্তন সভাপতি নাসিরুল হক জানিয়েছেন, খড়ের ছাউনির আটচালায় শুরু হওয়া বিদ্যালয় এখন আকার আকৃতিতে নজরকাড়া বিদ্যালয়ের রূপ পেয়েছে। দ্বিতল পাকা বাড়ির বিদ্যালয়ে এখন শ্রেণী কক্ষ সংখ্যা চল্লিশেরও বেশী। প্রতিষ্ঠা লগ্নে পড়ুয়া জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হলেও এখন উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নিত হওয়া এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৯-শোর কাছাকাছি। বিদ্যালয়ের পঠন পাঠন ভার সামলাচ্ছেন ২৫ জন শিক্ষক। সরকারি অর্থানুকূলো বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত উন্নয়নও ঘটেছে। রাজ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষকরা রবিবার ছুটি উপোভোগ করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার ভাবনাকে মান্যতা দিয়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও ঐতিহ্যশালী এই বিদ্যালয় রবিবার পড়ুয়াদে কোলাহলে মুখর থাকে। নাসিরুল হক গর্বের সঙ্গে বলেন, 'ব্যতিক্রমি এই ঐতিহ্য বজায় রেখেই এ রাজ্যে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় এক অনন্য বিদ্যালয় হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।'
এই বিদ্যালয়ের বর্তমান পড়ুয়া সৌম্যদীপ ঘোষাল, সোহিনী ঘোষ জানিয়েছে, ইতিহাস বই পড়ে তাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস জেনে থাকে। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় নিজেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই বিদ্যালয়ের সকল ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক শিক্ষিকারা এখনও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে জিইয়ে রেখেছেন। সৌম্যদীপ ও সোহিনীর কথায়,
অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমদের রবিবার ছুটি না হয় নাই কাটালাম। আমরা সবার আগে বিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকেই গুরুত্ব দিতে চাই। কেননা আমাদের বিদ্যালয় শুধু মাত্র জেলার ঐতিহ্যশালী বিদ্যালয় নয়, রাজ্যের মধ্যেও ব্যতিক্রম।
বিদ্যলয়ের টিচার ইন-চার্জ দেবব্রত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ১৯২২ সালে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কালীন প্রথম রেজিলিউশানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল,’রবিবার বিদ্যালয়ে পঠন পাঠন চালু রাখতে হবে। সোমবার থাকবে পূর্ণ দিবস ছুটি’। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের এই সিদ্ধান্তকে আজও লঙ্ঘন করা হয়নি। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, ছাত্র ছাত্রী, অভিবাবক এবং সর্বপরি গোপালপুর গ্রামের সকল বাসিন্দা এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।