২৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সম্প্রতি তুমুল শোরগোল ফেলে দেয় বঙ্গ রাজনীতিতে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে তোলা ওই ভিডিও-টিতে তিন আদিবাসী মহিলাকে 'দণ্ডি' দিতে দেখা গিয়েছিল। বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার আগে 'দণ্ডি' কাটেন তিন মহিলা। 'দণ্ডি' কেটে তাঁরা জানান, বিজেপির সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ ছিল না। দলবদলের এমন বেনজির-কায়দা ঘিরে হইচই পড়ে যায় রাজ্য রাজনীতিতে। ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই রাজ্যের শাসকদলের তীব্র সমালোচানায় সোচ্চার হয় বিরোধীরা। এই ঘটনার সরেজমিনে 'ছানবিনে' নেমে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসও জেনেছে, যে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের চাপেই ওই আদিবাসী তিন মহিলা 'দণ্ডি' কাটতে কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন।
তিন মহিলার মধ্যে একজনের স্বামীর সঙ্গে যোগযোগ করেছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তিনি এলাকার তৃণমূল নেতা বলেই পরিচিত। তিনিও স্বীকার করেছেন যে বিজেপিকে 'শিক্ষা' দিতেই এমন নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি করতে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদেরই 'চাপ' ছিল। তবে স্থানীয় তৃণমূলের কোনও নেতার নাম তিনি এব্যাপারে মুখে আনতে চাননি। গত ৬ এপ্রিল বালুরঘাট শহর থেকে থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে বদসানকাইরে একটি অনুষ্ঠান করেছিল বিজেপি। সেখানে শতাধিক মানুষ বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন বলে দাবি নেতৃত্বের। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মহিলা। ঠিক তার পরের দিনেই গুড ফ্রাইডে-তে তিন আদিবাসী মহিলাকে তৃণমূলে যোগ দিতে দেখা যায়। বিজেপির স্থানীয় কার্যালয়ের কাছাকাছি ও তৃণমূলের জেলা সদর কার্যালয়ের বাইরে 'দণ্ডি' কেটে শাসকদলে যোগ দিতে দেখা যায় তিন মহিলাকে।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী প্রদীপ্তা চক্রবর্তীর দাবি, তিন মহিলাকে বিজেপিতে যোগদানের জন্য "বিভ্রান্ত" করা হয়েছিল। তারই "প্রায়শ্চিত্ত" হিসেবে তাঁরা নিজরাই ফের তৃণমূলে ফেরার আগে 'দণ্ডি' কেটেছিলেন। এদিকে, তৃণমূলে ফেরার আগে তিন আদিবাসী মহিলাদের 'দণ্ডি' কাটার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই নিন্দার ঝড় ওঠে। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং তফসিলি উপজাতির জাতীয় কমিশনকে চিঠি লিখে এই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেন।
তিনি টুইটে শনিবার লিখেছিলেন, “মার্টিনা কিস্কু, শিউলি মার্ডি, ঠাকরান সোরেন এবং মালতী মুর্মু বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা এসটি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। আজ, তৃণমূলের গুন্ডারা তাদের শাসক দলে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। দণ্ডি কাটিয়ে তাঁদের শাস্তি দিয়েছে।” তিন আদিবাসী মহিলার 'দণ্ডি' কাটার ভিডিওটি প্রথমে সোশ্যাল মিডিায় আপলোড করলেও বিষয়টি নিয়ে তুমুল জলঘোলা হওয়ায় পরে পোস্টটি সরিয়ে নেন তৃণমূলনেত্রী প্রদীপ্তা চক্রবর্তী।
আরও পড়ুন- তাপপ্রবাহের সতর্কতা কলকাতা-সহ ৬ জেলায়, নববর্ষে ৪১ ডিগ্রি ছাড়াবে পারদ?
বালুরঘাট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মিশনপাড়ায় ওই তিন আদিবাসী মহিলা থাকেন। বুধবার, বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বছর একত্রিশের শিউলি মার্ডি এবং আরও দুই আদিবাসী মহিলা, ঠাকরান সোরেন, মার্টিনা কিস্কুরা জানান, ওই ঘটনা নিয়ে তাঁরা আর কথা বলতে চান না। এক সন্তানের মা শিউলি বলেন, “যা হয়েছে তা হয়েছে। আজ আমাদের দলের নেতারা এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সান্ত্বনা দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন তাঁরা আমাদের সঙ্গে আছেন এবং আমাদের সাহায্যও করবেন। আমরা এখন ঠিক আছি। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আমরা ছিলাম, আছি এবং থাকব। আমরা কখনও বিজেপিতে যোগ দিইনি।”
শিউলির স্বামী রাজেন তৃণমূলের স্থানীয় সহ-সভাপতি এবং প্রাক্তন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। তাঁদের বাড়ি থেকে মাত্র ২০ মিটার দূরে রয়েছে একটি অস্থায়ী পুলিশ পোস্ট। তাঁর স্ত্রী এবং অন্যান্য মহিলাদের দণ্ডি দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে রাজেন বলেন, “আমি ২০১৩ সালে থেকে তৃণমূলের সঙ্গে রয়েছি। দল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। আমি স্থানীয় নেতাদের থেকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলাম। আমার আর কিছু বলার নেই। তবে আমি আপনাকে বলতে পারি যে আমার স্ত্রী বা অন্য দুই মহিলা কখনও অন্য কোনও দলের সঙ্গে ছিলেন না। আমরা খ্রিস্টান, কীভাবে বিজেপিতে যোগ দেব?''
আরও পড়ুন- মুকুল দলে থাকলেও অতীত, ফের কবে জাতীয় দল তৃণমূল! বড় সংশয়ে রাজনৈতিক মহল
অন্যদিকে, শিউলির সঙ্গেই দণ্ডি কেটে তৃণমূলে যোগ দেন ঠাকরান সোরেনও। তাঁর স্বামী একজন দিনমজুর, ছেলে রাজমিস্ত্রি। তাঁর দাবি, তিনি কখনই বিজেপিতে যোগ দেননি এবং তাঁদের বিষয়টি মিডিয়ায় চাউর হওয়ার পর থেকে তিনি রাজেনের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এক সন্তানের মা কিস্কু বলেন, “ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর আমি ভয়ে থাকতাম। কিন্তু এখন ভালো আছি। আমার সঙ্গে তৃণমূলের নেতাদের কথা হয়েছে। আমার ভোটার কার্ডের ঠিকানা পরিবর্তন করতে হবে। সুবিধা পাচ্ছি না। তাঁরা বলেছে যে তারা প্রয়োজনীয় কাজ করবেন।” বুধবার তৃণমূলের রাজ্য আদিবাসী সেলের সভাপতি দেবু টুডু এবং তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের জেলা প্রধান স্নেহালতা হেমব্রম যিনি প্রদীপ্তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, তাঁরা ওই গ্রামে গিয়েছিলেন। তিন মহিলার সঙ্গে এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে তাঁরা কথাও বলেছিলেন।