কলকাতায় এসে সাতপাকে বাঁধা পড়লেন এক কানাডিয়ান দম্পতি। সৌজন্যে কলকাতার রূপান্তরকামী সংগঠন! সমাজকর্মী এবং তিনি হিন্দু ধর্ম নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন তাঁরা। বিগত বেশ কয়েকবছর ধরেই কলকাতার রূপান্তরকামীদের 'দুর্গাপুজো'র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত তাঁরা। করোনা পর্ব মিটতেই চলতি বছর দুর্গাপুজোয় রূপান্তরকামীদের পুজো চাক্ষুষ করতে সশরীরে হাজির হন তাঁদের পুজোয়। আর সব দেখে শুনে হিন্দু ভাবাবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু রীতি মেনে গাঁটছড়া বাঁধার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। সেই গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন 'ট্রান্স অ্যাক্টিভিস্ট' রঞ্জিতা সিনহা।
চলতি বছরে দক্ষিণ কলকাতার মুকুন্দুপুরের কাছে গরিমা গৃহের পুজো পঞ্চম বর্ষে পদার্পন করে। রূপান্তরকামীদের পুজো ঘিরে ছিল এক আলাদা উন্মাদনা। এই পুজোতে মা দুর্গা পুজিত হন বৈষ্ণব মতে। অর্ধনারীশ্বর রূপে মাতৃ মূর্তির আরাধনায় মেতে ওঠেন ওঁরা। পুজোর আলপনা দেওয়া থেকে ভোগ রান্না, সবটাই নিজেদের হাতেই করেন। পুজো শেষ প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়াতে বিশ্বাসী নন ওঁরা। কেন? পরিবার, সমাজ সব কিছু থেকেই তো ব্রাত্য আমরা তাই বিষাদের যন্ত্রণাটা আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায় জানালেন, পুজোর কর্ণধার রঞ্জিতা সিনহা। আর সেই পুজোতেই অংশ নেন এই কানাডিয়ান দম্পতি। গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবে রূপান্তরকামীদের পুজোর সাক্ষী থাকতে চেয়েছিলেন তাঁরা। পুজোর সকল আয়োজনে মুগ্ধ হয়ে এই দম্পতি হিন্দুশাস্ত্র মতে গাঁটছড়া বাঁধার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁদের সেই ইচ্ছা পূরণ করতে আসরে নামেন 'গরিমা গৃহে'র আবাসিকরা। মূল দায়িত্ব হাতে তুলে দেন রঞ্জিতা সিনহা। মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে বিয়ের যাবতীয় রীতি সম্পুর্ণ করেন রূপান্তরকামী পুরোহিত বৈশালী দাস।
আরও পড়ুন : < বিয়ের আগেই বাচ্চা? সারোগেসি বিতর্কে তামিলনাড়ু সরকারকে ‘কৈফিয়ত’ দিলেন নয়নতারা >
'ট্রান্স অ্যাক্টিভিস্ট' রঞ্জিতা সিনহা এই বিয়ে নিয়ে জানালেন, "দীর্ঘদিন ধরেই এই দম্পতি আমাদের পুজোর সঙ্গে যুক্ত। আমাদের পুজো ভারতীয় আচার অনুষ্ঠান আমাদের সম্প্রদায় নিয়ে ওনারা দীর্ঘদিন ঘরেই তাদের গবেষণা চালাচ্ছেন। সশরীরে আমাদের পুজো দেখার ইচ্ছা-প্রকাশ করেন ওঁরা। সেই সূত্রেই কলকাতায় আসা। আমাদের পুজো, চিন্তা ভাবনাতে মুগ্ধ হন ওঁরা। মায়ের সামনে ওঁরা সারাজীবন একসঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওঁদের ইচ্ছার মর্যাদা দিতেই আমাদের এই আয়োজন। দশমীর দিন আমরা ওঁদের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পুর্ণ করি। একেবারে হিন্দু শাস্ত্র মতে মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে পূর্ণ হয় ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়ের কথা ওঁরা ইতিমধ্যেই বাড়িতে জানান। এরপর দেশে ফিরে গির্জায় ওদের বিয়ের রীতি নিজেদের ধর্ম মতে পালন করবেন ওঁরা। সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতি ওঁদের এই ভালবাসা দেখে আমরা অভিভুত"।
রঞ্জিতার কথায়, “এই অর্ধনারীশ্বরের মূর্তি আমরা যে মা দুর্গাকে দেখতে পাই সব মণ্ডপে তার থেকে একেবারেই আলাদা। ইন্দ্র, শিব আরও বাকি যেসব দেবতাদের থেকে মা দুর্গা শক্তি পেয়েছেন সেই হরপার্বতীর যে রূপ যে একই অঙ্গে বিরাজ করে সেই রূপেই আমাদের এই মূর্তির পুজো হয়”। সমাজের কুসংস্কার, বাঁকা নজরকে উপেক্ষা করে নিজেদের মতো করেই পুজোর আনন্দ ভাগ করে নেন একে অপরের সঙ্গে। বাদ যায় না কিছুই। আড্ডা-মজা-খাওয়া দাওয়ায় পুজোর কটা দিন যেন ওঁদের কাছে এক আলাদাই তৃপ্তি, আর সেই সঙ্গে পুজো শেষে ভিনদেশি দম্পতির এই বিয়ে পুজোর আনন্দ আরও অনেক গুণে বাড়িয়ে দিল"।