দেবাশিস দেব (প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট):
নারায়ণবাবুর চলে যাওয়াটা আকস্মিক নয়। এটা আমরা জানতাম। বহুকাল বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন। একটা যুগ আজ শেষ হয়ে গেল। সৃষ্টিশীল মানুষেরা একটা সময় থেমেই যান। ওঁর যা দেওয়ার তারও অনেক বেশি উনি দিয়ে গেলেন। আমাদের কাছে সেটা একটা বিরাট প্রাপ্তি। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এক নাগাড়ে 'বাঁটুল', 'হাঁদা-ভোঁদা', 'নন্টে-ফন্টে' এঁকে গিয়েছেন। এটা একটা প্রায় বিশ্বরেকর্ডের মতো। এতদিন উনি পাঠককে আনন্দ দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি ছোটবেলা থেকেই ওঁর ইলাস্ট্রেশনের ভক্ত।
দেবসাহিত্য কুটিরের বইগুলো ছাড়াও শুকতারার ইলাস্ট্রেশন করতেন, কভার আঁকতেন। তাঁর ভক্ত ছিলাম আমি। শিল্পী হিসেবে ভার্সেটাইল ছিলেন। ওঁর সময়ে আর যাঁরা শিল্পী ছিলেন, এই যেমন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাই রায়, শৈল ক্রবর্তী, সমর দে'রাও খুবই শক্তিশালী ছিলেন। কিন্তু ওঁর মতো ভার্সেটাইল কেউ ছিলেন না। উনি একইসঙ্গে মজার ছবি ও সিরিয়াস অ্যাডভেঞ্চার ছবিও আঁকতেন।
১৯৬২ সালে প্রথম শুকতারার জন্য ওঁকে কমিকস আঁকতে বলা হয়। তারপরে 'বাঁটুল দি গ্রেট' রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ওঁর কাছে চাহিদা বাড়তে থাকে। পরে কিশোর ভারতীর জন্য 'নন্টে-ফন্টে' করেছিলেন। কোনওদিন পাকা চাকরি কোথাও করেননি। ফ্রিল্যান্স করতে করতেই জীবন কেটেছে। খুব একটা উচ্চাকাঙ্খা ছিল না। খুবই সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। আর্থিকভাবে নিজেকে ঠিক গুছিয়ে নিতে পারেননি। ফলে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল কখনও-কখনও। পরের দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওঁর দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর্থিক অনুদান, পুরস্কার পেয়েছেন। সম্প্রতি পদ্মশ্রী পেয়েছেন।
তবে নারায়ণ দেবনাথের সব থেকে বড় পাওয়া হল পাঠকদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। কমিকস শিল্পী হিসেবে আর কেউই এত ভালোবাসা, এত জনপ্রিয়তা পাননি। তিনি পাঠকদের নয়নের মণি ছিলেন। আমি ওঁর বাড়িতে গিয়েছি। খুবই সাধারণ মানুষ ছিলেন। নাম-ধাম, পয়সার দিকে খুবই নিষ্পৃহ ছিলেন। একইসঙ্গে পাঁচ, ছ'টা কমিকস চালিয়ে গিয়েছেন। আমি যখন যেতাম, তখন ওঁর আশি বছর পেরিয়েছে। নব্বই ছুঁয়েছেন তখনও গিয়েছি। তখনও ছবি এঁকে যাচ্ছেন, হাতও সচল ছিল।
স্ত্রী বিয়োগের পরেও স্টেডি ছিলেন। পরে ওঁর কিছু আঁকার সংকলন বই হয়ে বেরিয়েছে। যা জীবনে পেয়েছেন তাতে উনি তৃপ্ত। কমিকসে ওঁর মতো জনপ্রিয়তা আর কেউ পাননি। ওঁর 'বাঁটুল', 'হাঁদা-ভোঁদা' বাঙালিদের কাছে আইকন হয়ে গিয়েছে। এই অ্যাচিভমেন্ট আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেদিক থেকে আমার মনে হয় উনিই প্রথম ও উনিই শেষ। এই জনপ্রিয়তা ছোঁয়া খুবই মুশকিল। ওই যুগটাও আর নেই। শেষের দিকে 'বাঁটুল', 'হাঁদা ভোঁদা' পড়ার জন্যই তো লোকে শুকতারা কিনত বলে দেখেছি।