বাল্মিকীর রামায়ণ বলা হয়েছে শ্রীরামচন্দ্র দীপাবলির দিনে পৌঁছেছিলেন অযোধ্যায়। তাঁর নিজের রাজধানীতে। এরপর থেকে প্রতিবছর সেই দিনেই গোটা দেশ দীপাবলি উৎসব পালন করে। দীপাবলিকে আলোর উৎসব বলা হয়। অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভশক্তির সূচনা করে এই দীপাবলি। তবে গ্রাম বাংলার কুটির শিল্পে দীপাবলির সময়ে ঘনিয়েছে অন্ধকার। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক কুটির শিল্পীদের অন্নের সংস্থান প্রায় বন্ধের মুখে। তবে চালতাবেড়িয়া গ্রামের ছবিটা অন্য। বারাসত পেরিয়ে দত্তপুকুর।
দত্তপুকুরেরই ছোট্ট একটি গ্রাম চালতাবেড়িয়া। যশোর রোড ধরে যাওয়ার দুপাশে সারি সারি গাছ। এখানেই নজর পড়বে বহু দোকান। যার সামনে সারি দিয়ে সাজানো মাটির বহু জিনিস। প্রদীপ, মূর্তি, মাটির জলের বোতল থেকে শুরু করে নানা ঘর সাজানোর জিনিস। দোকানের আশেপাশেই রয়েছে একাধিক পাকা বাড়ি। সেখানে একসঙ্গে বসে কাজ করছেন শ্রমিকরা। কেউ বানান প্রদীপ, কেউ ছাঁচে ফেলে তৈরি করেন নানা দেবদেবীর মূর্তি। দত্তপুকুরের চালতাবেড়িয়া প্রদীপ গ্রাম নামে পরিচিত সকলের কাছে। গ্রামের প্রায় ১০০টিরও বেশি পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। কয়েক প্রজন্ম ধরে এই কাজই তারা করে যাচ্ছেন। এখানকার টেরাকোটা শিল্পের শিল্প সত্তার পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বের দরবারে। বাইরের অনেক দেশেই এখানকার মাটির তৈরি জিনিস রফতানি হয়।
চিনা রং বেরঙের টুনি বাল্ব, এলইডি আলোর সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছে এখানের মাটির তৈরি প্রদীপ। করোনার সময়কালে মাটির প্রদীপের চাহিদা কমলেও। এই বছর মাটির প্রদীপের বিক্রি বেড়েছে। চালতাবেড়িয়ার মাটির সামগ্রী তৈরির কারখানার মালিক শিল্পী স্বপন পাল জানিয়েছেন, তাঁদের তৈরি সামগ্রী রপ্তানি করা হয় বিভিন্ন রাজ্যে। গত তিন বছর ব্যবসা একদম ভালো ছিল না কিন্তু এই বছর যা অর্ডার এসেছে তাতে অনেক লাভ হয়েছে। তবে আমজনতার কাছে তাঁর আর্জি, যেন প্রত্যেকে চিনা আলো ছেড়ে প্রদীপ কেনেন। তাতে কমবে খরচও। এতে কুটির শিল্প এবং শিল্পী দুজনেই বাঁচবে। পশ্চিমবঙ্গে যেসব মাটির প্রদীপ বিক্রি হয় তা বেশিরভাগই আসে দত্তপুকুরের চালতাবেড়িয়া থেকে। কলকাতা ছাড়াও দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, গুজরাত, অসম, পাটনা, রাজস্থানেও রয়েছে এখানকার মাটির প্রদীপের চাহিদা।
কুটির শিল্পীরা তাদের হাতে তৈরি জিনিসগুলো পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করে বানান। দু’হাতের দশ আঙুলের জাদুতে হরেক রকমের মাটির প্রদীপ তৈরি করেন পুরুষ থেকে মহিলা সকলে। যশোর রোডের দু’পাশে চোখে পড়বে মাটির বিভিন্ন মূর্তি, পট, বিশেষ করে পিলসুজ আর প্রদীপ তৈরির কাজ চলছে। হিন্দু-মুসলিম মিলে মিশে সকলে এই মাটির জিনিস তৈরি করেন। একটি পিলসুজের উপরে এক সঙ্গে পাঁচ, সাত, নয়, একুশ, একান্নটি প্রদীপও তৈরি হচ্ছে। একান্নটি প্রদীপের নাম, ‘একান্ন দিয়া।’ বাজার ধরতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে প্রদীপের আদল। থাকছে বিভিন্ন কারুকাজ, সুক্ষ থেকে সুক্ষ কাজ যত্ন সহকারে করেন এখানকার শিল্পীরা।
লোকসান পুষিয়ে আশার আলো দেখছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও যে হারে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে তাতে বাইরে পণ্য পাঠানোতে একটু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পরিবহন খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। তার সঙ্গে বেড়েছে মাটির দাম। এক লড়ি মাটির দাম যেখানে ছিল ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এই খরচ পুষিয়ে বাইরে জিনিস পাঠানো মুশকিল। বাইরের রাজ্যে থেকে ভালো অর্ডার আসছে তাছাড়াও এই রাজ্যেও বিক্রি ভাল বেড়েছে। ঘর সাজানোর জন্যে অনেকে নিত্য নতুন প্রদীপ কিনছে। তাই এ'বছর খরচ পুষিয়ে যাচ্ছে, বলছিলেন শিল্পী সুজিত সাহা।
নতুন প্রজন্মের অনেকে এই হস্ত শিল্পের পেশায় এসেছে। এখন ভালোই রোজগার হচ্ছে এই কাজে। মৃৎশিল্পী সুকুমার পাল বলছিলেন, আগে অনেকে বাইরে কাজের জন্যে যেত এখন শিল্পীদের বাইরে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। ঘরে বসেই কাজ করলেই রোজগার হয়। অনেক যুবক যুবতী এখন এই পেশায় আসছেন।