বাংলা বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। বাইরের গরম আবহাওয়া জানান দিচ্ছে গ্রীষ্মের আগমনের। আর একদিন বাদেই বাংলার নতুন বছর শুরু। বাংলায় নতুন কোন সাল আসছে কিংবা বাংলার বারোটা মাসের নাম বলতে গেলে এখন অনেকে হিমশিম খাবেন। একসময় বাংলায় প্রতিটি ঋতুরই সংক্রান্তির দিন ছিল। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সব সংক্রান্তির সে উৎসব। তবে আজও বাঙালি আগলে রেখেছে সংক্রান্তির দুটি উৎসবকে। একটি চৈত্র সংক্রান্তি, অপরটি পৌষ সংক্রান্তি। বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণ কমতে কমতে এখন অনেক কিছুই অবলুপ্তির পথে। বাংলার কিছু কিছু গ্রামে আজও চৈত্র সংক্রান্তির আগে টিকে আছে পুরনো সব লোকাচার। এর মধ্যে অন্যতম গাজন উৎসব।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার বোলসিদ্ধি গ্রাম। কলকাতা থেকে বোলসিদ্ধির দুরত্ব একশ কিলোমিটারেরও বেশী। চৈত্র সংক্রান্তিতে আজও এই গ্রামে প্রাচীন রীতিনুযায়ী বহুযুগ ধরে পালন হয়ে আসছে প্রাচীন লোক উৎসবটি। বোলসিদ্ধি গ্রামের মানুষজন চড়কের আগে শুদ্ধভাবে চৈত্র মাসের প্রথম দিনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। একমাস ধরে নিরামিষ অন্ন ভোজন। গ্রামে একজন মূল সন্ন্যাসী থাকেন, যিনি বাকিদের নেতৃত্ব দেন। সন্ন্যাসীরা বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করেন। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন পালিত হয় নীলষষ্ঠী, সব সন্ন্যাসীদের উপবাস পালন করতে হয়। সংক্রান্তির দিন গ্রামের শিব মন্দিরে পুজো দিয়ে তিনবার প্রদক্ষিণ করে আগুন নিয়ে শুরু হয় খেলা। গ্রামের সকলেই এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সন্ন্যাসীরা আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুরে বেড়ান। সন্ধ্যে নামলে গ্রামেরই আরেক শিব মন্দিরে চড়ক পুজো করে উপোষ ভাঙ্গেন।
সূর্যসিদ্ধান্ত মতে বাংলা দিনপঞ্জির সূত্রপাত। বাংলার গৌড়ের শাসনকর্তা রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালের সঙ্গে বাংলা দিনপঞ্জিকে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হয়। আবার এ-ও মনে করা হয় যে সম্রাট আকবরের আমলেই এই বাংলা দিনপঞ্জি অনুসারে কৃষি খাজনা আদায় শুরু করা হয় কারণ চান্দ্র মতে তৈরি হিজরি দিনপঞ্জির সঙ্গে বাংলার কৃষির সময়কালের দ্বন্দ্ব রয়ে যাচ্ছিল।
এই দ্বন্দ্ব অপসারণের জন্য আকবর বাংলা দিনপঞ্জি অনুসারে খাজনা গ্রহণ যথোপযুক্ত মনে করেন। সম্রাট বকেয়া খাজনা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সংগ্রহের আদেশ দেন এবং চৈত্র সংক্রান্তির পর দিন পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হত নতুন খাতা বা হালখাতা। বাংলার মানুষ নতুন হিন্দুশাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যময় বলে মনে করা হয়।
এক সময় এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি উৎসব হতো চৈত্র সংক্রান্তিতে। সংক্রান্তির দিন শিবের গাজন বা চড়ক পূজা, আর তার আগের দিন নীল পূজা। সেও শিবেরই পূজা। সমুদ্রমন্থনকালে উত্থিত বিষ কণ্ঠে ধারণ করে শিব নীলকণ্ঠ, তাই নীল পূজা। মায়েরা নীলের উপোস করে সন্তানের মঙ্গল কামনায়। শিব নীলকণ্ঠ—জগতের সব বিষ পান করেও সত্য সুন্দর মঙ্গলময়। সেই কোন কাল থেকে বাংলা জুড়ে চলে আসছে এই প্রবহমান লোক উৎসব কেউ সময় বলতে পারে না হিসেব করে। বাংলার গ্রামে গ্রামে এই উৎসব নিয়ে আসে নতুন বছরের আগমন বার্তা।
শিবঠাকুরের বিয়েকে কেন্দ্র করে বাংলার শেষ মাসের দিনগুলোতে যে লোক উৎসবটি হয়ে থাকে, তার নামই 'গাজন'। অর্থাৎ গ্রামের 'গা' আর জনসাধারণের 'জন' থেকেই 'গাজন' কথাটির আগমন হয়েছে বলে মনে করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গাতেই গাজন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা পঞ্জিকার চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
ইতিহাসে চড়ক গাজন নিয়ে লোকমুখে নানা কথার প্রচলন রয়েছে। বাংলা বছরের শেষে চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। চৈত্র ফুরিয়ে আসছে, বৈশাখ শুরু হল। গৃহস্থরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন গ্রীষ্মের তপ্ত দিনগুলো সুস্থ ভাবে পার করে আষাঢ়ে আকাশ ভরা মেঘ দেওয়া যাতে ঘরে সোনার বরণ ধান ওঠে। ছেলেমেয়ের মুখে দুটো নতুন চালের ভাত তুলে দেওয়া যায়। শিবের এই গাজনে মহাদেবের সঙ্গে হরকালীর বিবাহ হয় এই দিনে। অনেকে বলেন, এই গাজন উৎসবের সঙ্গে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের পুনরায় হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। মধ্যযুগে যখন ভারতবর্ষে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বৌদ্ধ ধর্ম, সেই সময় এই দেশের বিভিন্ন স্থানে শরণার্থী হিসেবে থাকতে শুরু করেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। বাংলার কিছু জেলাতেও তাঁরা ছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁরা আবার ধর্মান্তরিত হন। তাই এই প্রত্যাবর্তনের উৎসব শিব বন্দনার উৎসবে পরিণত হলেও, বৌদ্ধ ধর্মের কিছু তান্ত্রিক প্রক্রিয়া এখনও এই উৎসবের সময় পালন হতে দেখতে পাওয়া যায়।
লোকমুখে প্রচলন, এই উৎসব প্রথমে ধর্মরাজের গাজন হিসেবে পরিচিত ছিল। সেটা ছিল বৌদ্ধদের উৎসব। পরবর্তীকালে তা হয়ে উঠেছে শিবের গাজন। এই গাজন উৎসবের আয়োজন প্রধানত গ্রামে বা মহল্লায় শিবের মন্দিরের মধ্যে কিংবা তার সামনে করা হয়। মেলা ও পুজো দেখতে দূর দূর গ্রাম থেকে বহু মানুষ আসে। এই গাজন উৎসবের সময়েই নীল পুজোরও আয়োজন করা হয়।
পুজোতে বিবাহিত মহিলারা সারাদিন উপোস থেকে সন্ধ্যাবেলা শিব লিঙ্গের মাথায় জল ঢালেন। অনেকের ধারণা, শিব ও পার্বতীর বিবাহের উৎসব পালন করার জন্যই এই নীল পুজোর আয়োজন করা হয়। সমুদ্র মন্থনের সময় বেরিয়ে আসা বিষ নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন মহাদেব। তাই শিবের আর এক নাম নীলকণ্ঠ।
নীলের পুজো মানেও শিব পুজো। চড়ক পূজায় যোগদানকারী সন্ন্যাসীদের শিবের সন্ন্যাসী বলা হয়। এরা তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাসের ফলে নিজেদের শারীরিক কষ্ট দিয়ে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। যেমন—তিরিশ চল্লিশ ফুট উঁচু চড়ক গাছ থেকে পিঠে বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া, জিভে বা শরীরের কোনো জায়গায় লোহার শিক গেঁথে দেওয়া বা ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আগুনের খেলা দেখানো ইত্যাদি। তবে বর্তমানে এই সব বিপজ্জনক কসরত অনেক ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।