নকশালবাড়ি আন্দোলনের রূপকার চারু মজুমদারের জন্মের মাস তারিখ অজ্ঞাত। ১৯৭২ সালের ২৮ জুলাই তাঁর মৃ্ত্যু হয়েছিল। নকশাল আন্দোলেনের সঙ্গে যাঁরা যু্ক্ত তাঁরা তো বটেই, এমনকি অন্য ধারার রাজনীতির অনেকেই মনে করেন, তাঁকে জেলে হত্যা করা হয়েছিল। এ বছর চারু মজুমদারের জন্মশতবার্ষিকী যে পালন করা হচ্ছে, তার একটি ভিত্তি পরিবারের দেওয়া হিসাব।
যেহেতু নকশাল আন্দোলন বহুধাবিভক্ত, ফলে জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানও একাধিক। এ নিয়ে কোনও পক্ষেরই কোনও জড়তা নেই। তাঁদের মধ্যেকার বিভক্তির ধারাবাহিকতা মেনেই একাধিক জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি, একাধিক জায়গায় অনুষ্ঠানের আয়োজন। কলকাতা শহরে সর্বপ্রথম কিছুটা জাতীয় ধাঁচের এরকম এক অনুষ্ঠান আয়োজিত হল ২৭ জুলাই, কলকাতার ফুলবাগানের সুকান্ত মঞ্চে।
আয়োজক ছিল চারু মজুমদার জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি। সেখানে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন বি অনুরাধা, মহারাষ্ট্র থেকে বার্নার্ড ডি মেলো, ঝাড়খণ্ড-বিহারের বিভিন্ন রকমের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরাও।
চারু মজুমদারের ছেলে অভিজিৎ মজুমদার এ কর্মসূচির সঙ্গে নেই। তিনি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সঙ্গে যুক্ত। লিবারেশনের এ সংক্রান্ত কর্মসূচি ৩০ জুলাই, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে।
অন্য দুটি নকশালপন্থী গোষ্ঠী শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে ২৮ জুলাইতেই সভা করছে।
চারু মজুমদার নিয়ে কোনও কর্মসূচিই পালন করছে না ভাঙড়ের জমি আন্দোলন করে কিছুদিনের জন্য শিরোনামে আসা সিপিআইএমএল রেড ফ্ল্যাগ। তাঁদের দলের নেতা শংকর দাস জানালেন, “এমন নয় যে চারু মজুমদারের অবদান আমরা স্বীকার করি না। তবে আমাদের ক্ষমতা অনুযায়ী গুরুত্ব অনুসারে যে কাজগুলি আমরা হাতে নিয়েছি, তার মধ্যে আলাদা করে চারু মজুমদার জন্মশতবর্ষপালনের কর্মসূচি নেই।”
এতগুলি আলাদা আলাদা রকমের কর্মসূচি যখন চারু মজুমদারকে নিয়েই হচ্ছে, তখন ঐক্যবদ্ধ নকশালপন্থী পার্টির কোনও সম্ভাবনাই কি নেই?
সিপিআইএমএল নিউ ডেমোক্রেসির তরফে চন্দন প্রামাণিক জানালেন, “একটি ঐক্যবদ্ধ পার্টি তৈরি আমাদের মূল কাজ। তা ছাড়া ভারতবর্ষে বিপ্লব অসম্ভব। নকশালপন্থীদের অনেকেই মনে করেন, তাঁদের গোষ্ঠীটিই একটি পার্টি। কিন্তু আমরা তা মনে করি না। তবে লিবারেশন বা মাওবাদীদের সঙ্গে আমরা ঐক্য করব না।”
চারু মজুমদারের পুত্র অভিজিত মজুমদার মনে করেন, মাওবাদীদের সঙ্গে তাঁদের অর্থাৎ সিপিআইএমএল লিবারেশনের ফারাক কৌশলগত। “রণনীতির প্রশ্নে আমরা দুপক্ষই কৃষিবিপ্লবের পক্ষে। তবে ভারতবর্ষে যে ফ্যাসিবাদী রাজ কায়েম হয়েছে, তাতে গণসংগঠন-গণআন্দোলন বা নির্বাচন বয়কটের রাজনৈতিক লাইন এখন কার্যকর হবে না। ৬৯ সালে রাজনীতির পরিস্থিতি যে জায়গায় ছিল, তখন সে আহ্বান সঠিক ছিল।”
কী মনে আছে সেদিনের কথা! অভিজিত তখন বারো বছরের কিশোর। মনে করতে পারেন, “মর্গে প্রথম ট্রে খুলল, অন্য লোক। দ্বিতীয় ট্রে খুলল, অন্য লোক। তৃতীয় ট্রে খুলতে বেরিয়ে এল আমার বাবার শব। পায়ের তলা কালো হয়ে গেছে। কেন কালো, জানি না। চারু মজুমদারে অ্যাজমা ছিল, পেথিডিন দিতে হত। অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকর কথা। সে সব কিছু দেওয়া হয়নি। তা যে দেওয়া হয়নি, সে কথা সে সময়ের পুলিশ অফিসার রুণু গুহনিয়োগীর বইতেই রয়েছে। পায়ের তলার কালো দাগ নিয়ে পোস্ট মর্টেমে আলাদা করে কিছু বলা ছিল না।”
“মর্গ থেকে বেরিয়ে ক্যাওড়াতলা শ্মশানে যখন আমরা পৌঁছই, সে সময়ে একটা ভাঙা দেওয়ালের উপর সারি সারি রাইফেলধারী দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। শহর কলকাতায় তখন অঘোষিত কারফিউ। জোর করে অন্য সব শবযাত্রীদের বের করে দেওয়া হল। আমার মা বলেছিলেন, মুখটা একটু খুলুন, আরেকবার দেখব। সে কথা শোনেনি পুলিশ। মুখ ঢাকা অবস্থাতেই আমার হাতে কয়েকটা জ্বলন্ত পাটকাঠি ধরিয়ে মুখাগ্নির মত কিছু একটা করিয়ে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ভরে দেওয়া হয় চারু মজুমদারের মৃতদেহ।”
সেদিনের বাস্তবতা থেকে দূরে থাকা, ও অভিজিত মজুমদারের রাজনীতির অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বি অনুরাধার মুখে শোনা গেল আরেক বাস্তবের কথা। জেল খাটা অনুরাধা বলছিলেন দণ্ডকারণ্যের জনাতন সরকারের কথা। জনাতন সরকার, মানে জনতার সরকার। তিনি বলছিলেন, “বলা হয়, ও অঞ্চলে নাকি স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আসল ঘটনা হল, সে স্কুলগুলিই পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যেখানে পড়াশোনা বন্ধ করে সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর আস্তানায় পরিণত করা হয়েছে। অনুরাধার দাবি, ওখানে, জনাতন সরকার স্কুল চালায়। সেখানে পাঠক্রমের দুটি ধারা, একটি প্রাথমিক ও তারপর রাজনৈতিক। এমনও জানা গেল অনুরাধার কথায়, জনাতন সরকারের মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন এক নেত্রীই। কোনও নেতা নন।”
তবে এ সবের মাঝে একটা ঐতিহাসিক সংশয় রয়েই যাচ্ছে। চারু মজুমদার সম্পর্কিত উইকিপিডিয়া পাতায় দেখা যাচ্ছে তাঁর জন্ম ১৯১৮ সালে। ১৯১৯ সালের কথা বলছেন চারু মজুমদারের পরিবারের সদস্যরা। আবার আরেক দল, যাঁরা অভিজিত মজুমদারের সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে সংস্রব এড়িয়ে চলতে চান, তাঁরা বলছেন, সরোজ দত্তের লেখায় আছে, চারু মজুমদার তাঁর থেকে পাঁচ বছরের ছোট। সরোজ দত্তের জন্মসাল ১৯২৪ থেকে ব্যাক ক্যালকুলেশন করছেন তাঁরা। কিন্তু উইকিপিডিয়ার পাতাটা আর কেউই বদলে উঠছেন না।