মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বার্তার পরেও ’তোলা’ আদায় থেকে বিরত হতে নারাজ একাংশ তৃণমূল নেতা। এটা যে নিছক কথার কথা নয়, তারই বাস্তব প্রমাণ মিললো পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের চিকনহাটি গ্রামের এক তৃণমূল নেতার কার্যকলাপে। ব্লকের ভিলেজ রিসোর্স পারসন (ভিআরই)পদে কর্মরত অভিযুক্ত ওই তৃণমূল নেতার নাম বিশ্বজিৎ ঘোষ। তাঁর বিরুদ্ধে তোলা বাজির অভিযোগ তুলেছে একটি ঠিকাদার সংস্থা। ওই সংস্থার অভিযোগ, তাদের কাছ থেকে মোটা টাকা তোলা চেয়েও না পেয়ে চিকনহাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেলেন্ডার কল বসানোর কাজ বন্ধ করিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতা বিশ্বজিৎ ঘোষ। তাঁর বিরুদ্ধে জামালপুর থানা ও বিডিওর দফতরে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে নির্মাণকারী সংস্থার কর্ণধার শেখ মারজান আলীর পক্ষে। অভিযোগ পেয়েই নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কর্তারা।
জামালপুর ব্লকের চকদিঘী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম চিকনহাটি। এই গ্রামেই এক প্রান্তে রয়েছে চিকনহাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানকার পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল রান্না ও পানীয় জলের সংস্থানের জন্যে জামালপুর পঞ্চায়েত সমিতি ওই বিদ্যালয়ে একটি সেলেণ্ডার কল বসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মত কাজেও লেগে পড়ে নির্মাণকারী সংস্থার লোকজন। প্রশাসনকে নির্মাণকারী সংস্থার কর্ণধার মারজান আলী জানিয়েছেন, চিকনহাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেলেন্ডার কল বসানোর জন্য পঞ্চায়েত সমিতি ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ করে। তাঁর সংস্থা কল বসানোর কাজের বরাত পায়। কাজ শুরুর আগে তিনি ও তাঁর লোকজন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও এলাকার সন্মানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। ওনাদের দেখিয়ে দেওয়া বিদ্যালয়ের জায়গায় গত সোমবার সিলিন্ডার কল বসানোর কাজ শুরু হয়।
মারজান আলীর অভিযোগ, শ্রমিক ও মিস্ত্রিরা কল বাসানোর কাজ শুরু করতেই চিকনহাটির তৃণমূল নেতা বিশ্বজিৎ ঘোষ তাঁর দলবল নিয়ে বিদ্যালয়ে পৌছে গিয়ে কাজে বাধা দেয়। ওই তৃণমূল নেতা নাকি হুমকি দিয়ে বলেছেন, '১০ হাজার টাকা তোলা না দিলে কল বসানোর কাজ করতে দেব না।' ৭০ হাজার টাকার কল বসাতে গিয়ে ১০ হাজার টাকা তোলা দেওয়া সম্ভব নয় বলে দাবি নারজানের। তাই চিকনহাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কল বসানোর কাজ স্থগিত করে দিয়ে সমস্ত সরঞ্জাম গুটিয়ে নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে ঠিকাদারী সংস্থার কর্ণধার মারজান আলী প্রশাসনকে জানিয়েছেন।
ঠিকাদার সংস্থার কর্ণধার এমন অভিযোগ আনার পর অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা বিশ্বজিৎ ঘোষের প্রতিক্রিয়ার জন্য বুধবার বেলায় চিকনহাটি প্রামিক বিদ্যালয়ে পৌছতেই তাজ্জব ঘটনা নজরে পড়ে। দেখা যায় বিদ্যালয়ের চারপাশে ও বিদ্যালয় ভবনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে অজশ্র মদের বোতল। বিদ্যালয়ে মদের আসর যে নিয়মিত বসে তা এলাকাবাসী কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। খানিক বাদে তৃণমূল নেতা বিশ্বজিৎ ঘোষ চিকনহাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজির হন। তাঁকে ঠিকাদার সংস্থার আনা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। পাল্টা বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, 'আমি এলাকার তৃণমূলের নেতা। পাশাপাশি তিনি চকদিষী পঞ্চায়েতে ভিলেজ রিসোর্স পারসনের কাজ করি। এনআরইজিএস এর কাজও দেখাশুনা করি। সেই কারণেই আমি এলাকার কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়ে গিয়ে সেলেন্ডার কল বসানোর কাজে যুক্ত শ্রমিকদের কাছে ওয়ার্ক অর্ডার ও অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাই। ঠিকাদার সংস্থার কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলি। তবে কোনও টাকা পয়সার দাবি কারোর কাছে করিনি।' বিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা এলাকার জনপ্রতিনিধি বা বিদ্যালয় পরিচালন কমিটির কেউ না হয়েও বিশ্বজিৎ ঘোষ কোন এক্তিয়ারে বিদ্যালয়ের সেলেন্ডার কল বাসানোর ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করেন? জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন এই তৃণমূল নেতা।
চকদিঘী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান গৌরসুন্দর মণ্ডল বলেন, 'চিকনহাটি গ্রামের বিশ্বজিৎ ঘোষ যে পঞ্চায়েতের ভিলেজ রিসোর্স পারসন সেটা আমি জানি। তবে বিশ্বজিৎ কবে তৃণমূলের নেতা হয়ে গেল সেটা আমার জানা নেই। ওর কীর্তিকলাপের কথা জানার পর আমি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রী যেখানে উন্নয়ন কাজে গতী আনতে চাইছেন সেখানে বিদ্যালয়ে সেলেন্ডার কল বসানোর কাজে বাধা দিয়ে বিশ্বজিৎ ঠিক করে নি। এইসব বরদাস্ত করা হবে না। প্রশাসন বিশ্বজিতের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে বললে পঞ্চায়েত সেটাই কার্যকর করবে।'
জামালপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ্য তথা ব্লক তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি ভূতনাথ মালিক বলেন , 'বিশ্বজিৎ ঘোষ স্বঘোষিত তৃণমূল নেতা। বিদ্যালয়ে সেলেন্ডার কল বসানোর কাজ বন্ধ করিয়ে দিয়ে বিশ্বজিৎ চরম অন্যায় করেছে। ওর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া কথা প্রশাসনকে বলা হবে।'
জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি সৌম্যরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'তৃণমূলের নেতাদের দেখাদেখি ভিলেজ রিসোর্স পারসনরাও যে এখন তোলাবাজিতে নেমে পড়েছে সেটা বিশ্বজিতের কীর্তিকলাপ থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিশ্বজিতের মত তোলাবাজরাই এখন তৃণমূলের সম্পদ। সেই কারণে প্রশাসন বিশ্বজিৎতের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে বলে কেউ বিশ্বাসও করে না।'
জামালপুরের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদারের কথায়, 'দীর্ঘদিন ধরে চিকনহাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সেলেন্ডার কল বসানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন কর্তৃপক্ষ। সেই দাবিকে মান্যতা দিয়ে পঞ্চায়েত সমিতি ওই বিদ্যালয়ে সেলেন্ডার কল বসানোর উদ্যোগ নেয়। তার জন্যে ১৫তম ফিনান্স কমিশন থেকে অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু ঠিকাদার সংস্থা অভিযোগ জানিয়েছে ব্লকের ভিলেজ রিসোর্স পারসন বিশ্বজিৎ ঘোষ ওই বিদ্যালয়ে কল বসাতে বাধা দিয়েছে এবং ঠিকাদার সংস্থার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেছে। এই অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে বিশ্বজিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় জন্যে পুলিশকে বলা হবে।'