Advertisment

দুর্দিন কাটিয়ে চিৎপুর যাত্রাপাড়ায় রথের দিনে লক্ষ্মী এলো

টালিগঞ্জ যদি বাংলা সিনেমার পীঠস্থান হয়, তবে চিৎপুর যাত্রার।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
chitpur jatra para is returning to its rhythm after passing poor time

অসময় কাটিয়ে ছন্দে ফিরছে চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

টালিগঞ্জ যদি বাংলা সিনেমার পীঠস্থান হয়, তবে চিৎপুর যাত্রার। যাত্রাপাড়া বলতে সকলে একডাকে চেনেন চিৎপুরকে। এখানের ঘিঞ্জি রাস্তা, ট্রামলাইনের উপরে হাতে টানা রিক্সা, ট্যাক্সি ভ্যানের উপদ্রব সামলে চোখ চলে যায় দেওয়াল জুড়ে রং বেরঙের সব পোস্টারের দিকে। লাইন ধরে সারিবদ্ধভাবে ছোট বড় দোকানে সব পসরা সাজিয়ে বসে যাত্রাপালার বিভিন্ন দল। উত্তর কলকাতার এই এলাকায় এলে যেন মনে হয় তিলোত্তমার বুকে এক টুকরো রঙ্গিন ক্যানভাস। চারপাশে শুধু রঙ ছড়িয়ে আছে। মহামারীর সময়ে সেই রং যেন ফিকে হয়ে এসেছিল, বিনোদনী সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কোনওরকমে টিকে ছিল যাত্রাপাড়ার সব দলগুলো।

Advertisment

গত দু'বছরের ক্ষত সামলে ফের পুরনো ছন্দে ফিরছে যাত্রাপাড়া। যেসব শিল্পীরা দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন যাত্রার বুকিং মিলতেই সেসব শিল্পী ও কলাকুশলী পুরনো পেশায় ফিরছেন। রথ যাত্রার দিনই যাত্রা অ্যাকাডেমিতে ধুমধাম করে পুজোর শেষে দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটানো হল নতুন যাত্রার পোস্টার। নতুন শো-এর বায়না করতে ভিড় করছিল বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষজন। বহুদিন পরে যাত্রাপাড়া যেন ফিরে পেল তার সোনালি দিন।

publive-image
মহামারীর পর থেকে মানুষজন সিরিয়ালের প্রতি আগ্রহ হারায়। যাত্রাদলগুলো এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দর্শকদের জন্য নতুন যাত্রা নিয়ে আসে।

মহামারীর প্রকোপে ২০২০ থেকে ধুঁকছিল যাত্রাশিল্প। লকডাউন ওঠার পরও কোভিড আতঙ্কে যাত্রাপাড়ায় বুকিং একদম কমে গিয়েছিল। তবে এবছর মরশুমের শুরু থেকেই রয়েছে শোয়ের চাপ। নতুন যাত্রার বায়না করতে অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসছেন। অনেক যাত্রাদল একদিনে একাধিক জায়গা থেকে বুকিংও পাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন বাংলার মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল যাত্রাপালা। চলচ্চিত্র জগতের অনেক নামী দামী শিল্পীও যাত্রায় অভিনয়ের সঙ্গে ছিলেন। উত্তর কলকাতার চিৎপুরে যাত্রাপাড়ায় ব্যস্ততা সারা বছরই লেগে থাকত। রথের দিন থেকে যাত্রাদলগুলো নতুন স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির হতেন। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে নায়েকরা আসতেন বায়না করতে।

মিষ্টিমুখ খাওয়া-দাওয়া সহ এলাহি আয়োজন হতো। পুজো দিয়ে শুরু হত যাত্রার বুকিং। কোভিডের আগে থেকে যাত্রাপাড়ায় সেই চেনা ছবি হারিয়ে যেতেই বসেছিল এবছর যেন পুরনো সেই দিনগুলোয় ফিরে এসেছে। রথের দিন থেকে শুরু বুকিং। "গ্রামবাংলার নতুন করে মানুষ যাত্রাপালার দিকে ঝুঁকছে। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট তার আগে মানুষ যেভাবে এসে নতুন যাত্রার বুকিং করে গিয়েছে এতে বোঝাই যাচ্ছে সারা বছর বেশ ভালই কাটবে। যাত্রার সিজন চলে দুর্গাপূজার ষষ্টি থেকে ৩১শে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত। এখনই যা বুকিং হচ্ছে তাতে শেষ দুবছরের দুঃখ অনেকটায় লাঘব হবে।" বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের যুগ্ম সম্পাদক রূপকুমার ঘোষ।

publive-image
ঘিঞ্জি রাস্তা, ট্রামলাইনের উপরে হাতে টানা রিক্সা, ট্যাক্সি ভ্যানের উপদ্রব সামলে চোখ চলে যায়।

আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর আগেও চণ্ডীমণ্ডপ ঘিরে বসে অপেক্ষা করতেন আট থেকে আশি। সে দিনগুলো হত আলাদা। সামান্য থেকে সামান্য জিনিসেই বিনোদন খুঁজে নিতেন। টেলিভিশন ছিল দূর অস্ত, স্মার্টফোন যখন কল্পবিজ্ঞানের স্বপ্নকথা, সে সময়ে একঘেঁয়ে জীবনে বিনোদনের রসদ জোগানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল তিন দিক খোলা মঞ্চ। সারাদিনের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে বাড়ির পুরুষেরা জড়ো হতেন এক জায়গায়। সন্ধ্যে থেকে শুরু হত যাত্রাপালা। কচিকাঁচাদের সঙ্গে কখনওসখনও যেতেন বাড়ির মহিলারাও। চণ্ডীমণ্ডপের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে এক সময় শুরু হল কাউন্টার থেকে টিকিট কাটার পালা।

চটের ঘেরাটোপে কলকাতা থেকে আসা শুরু হল যাত্রাদলের। দিন গেলেও সে স্মৃতি এখনও তরতাজা গ্রামের অনেক বৃদ্ধদের মনে। কলকাতার চিৎপুরের নাম করা যাত্রাদলের নাম, যাত্রাপালা ও অভিনেতাদের নাম প্রায় মুখস্থ থাকতো সকলের। বীণা দাশগুপ্ত, জ্যোৎস্না দত্ত, গুরুদাস ধাড়া, শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, বেলা সরকার, অশোক কুমার, মোহন চট্টোপাধ্যায়, শান্তিগোপাল, স্বপনকুমার, পান্না চক্রবর্তী, ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়রা আজও উজ্জ্বল প্রবীণদের স্মৃতিতে।

publive-image
রথের দিন থেকে যাত্রাদলগুলো নতুন স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির হতেন। পুজো দিয়ে শুরু হত যাত্রার বুকিং।

টেলিভিশন আসার পর এই বিনোদনের জনপ্রিয়তা অনেকটা হারিয়েছে। সিনেমা সিরিয়াল দেখতেই বেশ আগ্রহী হয়ে পরে সকলে। কিন্তু মহামারীর পর থেকে মানুষজন সিরিয়ালের প্রতি আগ্রহ হারায়। একঘেয়ে সিরিয়াল সিনেমা থেকে নতুন কিছু দেখার জন্যেই দর্শক আবার আগের মতন যাত্রা দেখার দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করছে রাজলক্ষ্মী অপেরার প্রযোজক অশোক দাস। তিনি বলছিলেন, "বছর দশেক ধরে যাত্রার জনপ্রিয়তা একটু কমে গিয়েছিল বটে। করোনার সময়ে তো অবস্থা খুব খারাপ ছিল।

গত বছর পুজোর পর থেকে যাত্রার শো চাঙ্গা হয়েছে। যা রীতিমত অবাক করার মতন। শহরেও অনেক জায়গায় যাত্রার শো হচ্ছে। রথের দিন এলে বুঝতে পারতেন কত মানুষ এসেছে বায়না করতে। সিরিয়াল এখন আর কেউ দেখতে চাইছে না। সিরিয়ালের তাবড় তাবড় অভিনেতা অভিনেত্রী এখন যাত্রার দলে আসছে। আমার নিজের দলেই অনেক নামজাদা সিরিয়ালের অভিনেত্রীরা রয়েছেন"

publive-image
একসময় কলকাতার চিৎপুরের নাম করা যাত্রাদলের নাম, যাত্রাপালা ও অভিনেতাদের নাম প্রায় অনেকেরই মুখস্থ থাকত

সময় পাল্টাচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টাচ্ছে, মানুষের রুচি। যাত্রাপাড়ার যাত্রাদলগুলো সে কথা মাথায় রেখে এখন চিত্রনাট্য তৈরি করছেন। আগের মতন চড়া মেকআপ, উঁচু তারে বাঁধা মেলোড্রামা, অতি উচ্চকিত সংলাপেও পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে। তার জন্যেই হয়তো মানুষদের মধ্যে বেড়েছে যাত্রার গ্রহণযোগ্যতা। যাত্রাপাড়ার এক পরিচালক নেপাল দত্তের মতে, "এখন নতুন কিছু ভাবার সময় এসেছে। দর্শকের পছন্দের কথা মাথায় রেখে যাত্রা লেখা হচ্ছে। এসবের জন্যেই হয়তো আমরা আবার নতুন করে বেঁচে উঠছি। যাত্রার সুদিন ফিরছে কিনা জানিনা তবে দুর্দিন কেটে গিয়েছে।"

publive-image
রথের দিন থেকে যাত্রাদলগুলো নতুন স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির হতেন। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে নায়েকরা আসতেন বায়না করতে

রঙবেরঙের পোস্টার সাজানো দোকানে বসে থাকা ম্যানেজারদের মুখের হাসি এখন চওড়া। দিনের শেষে ভরছে পকেট। লোকসানে চলা চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় হয়েছে লক্ষ্মীলাভ। বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতিকে মানুষ আবার ভালোবেসে গ্রহণ করছে তার জন্যেই হয়তো ধুঁকতে থাকা যাত্রার দলগুলো বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেয়েছে।

kolkata yatra West Bengal jatra
Advertisment