কয়লা ব্যবসায়ী রাজু ঝাকে গুলি করে খুনের ঘটনার পর থেকে পেরিয়ে গেল দু’দিন।গুলি চালানোর ঘটনায় জড়িত দুস্কৃতিদের এক জনকেও এখনও জালে পুরতে পারেনি পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ। শ্যুটারদের খোঁজে তদন্তকারী পুলিশের একটি দল সোমবার সকালে যখন ঝাড়খণ্ড রওনা দেই সেই সময়েই রাজু ঝাকে খুন কাণ্ডে প্রকাশ্যে আসল বিস্ফোরক তথ্য।
যে সাদা রঙের গাড়িরসাওয়ারি রাজু ঝাকে দুস্কৃতিরা একের পর এক গুলি চালিয়ে খুন করে সেই গাড়িতে ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেই ছিলেন গরু পাচার মামলায় ফেরার অভিযুক্ত আব্দুল লতিফ। ঘটনার পরেই লতিফ ঘটনাস্থল থেকে গায়েব হয়ে যান। শক্তিগড় থানায় দায়ের করা লিখিত অভিযোগে আব্দুল লতিফের গাড়ির চালক সেখ নুর হোসেন এমনটাই উল্লেখ করেছেন। এই তথ্য সামনে আসার পরেই প্রশ্ন উঠেছে,তাহলে কি রাজু ঝা কে খুনের ঘটনায় আব্দুল লতিফ-ই মূল চক্রান্তকারী ছিলেন? রাজু ঝার ইডি দফতরে যাওয়া আটকাতেই কি তাকে খুন করা হল? এই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কয়লা পাচার মামলায় রাজু ঝার সোমবার ইডি দফতরে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। তার ঠিকআগেই শনিবার রাত ৮টা নাগাদ শক্তিগড়ে কলকাতামুখী ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে একটি ল্যাংচার দোকানের সামনে দাঁড়ায় সাদা রঙের ফরচুনা গাড়ি। ওই গাড়ির চালকের বাঁদিকের আসনে বসে ছিলেন কয়লা করবারী রাজু ঝা। গাড়ির পিছনের আসনে বসে ছিলেন রাজু ঝার সহযোগী ব্রতীন মুখোপাধ্যায় ও সিবিআইয়ের খাতায় নাম থাকা গরু পাচার মামলায় ফেরার অভিযুক্ত আব্দুল লতিফ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী সাদা ফরচুনা গাড়ির পিছন পিছন নীল রঙের একটি দামি চারচাকা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীল রঙের গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমেই একেবারে শার্প শ্যুটারের কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই ফরচুনা গাড়ির আরোহীদের লক্ষ্য করে পরপর গুলি চালায়। গুলি চালিয়েই নীলচে রঙের গাড়িতে চেপেই দুষ্কৃতীরা দ্রুত কলকাতা মুখি রোড ধরে পালিয়ে যায়। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় রাজু ঝার শরীর। পিছনের আসনে বসে থাকা ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ের বাম হাতে গুলি লাগে। কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে আব্দুল লতিফ ও তাঁর গাড়ির চালক নুরকে দুস্কৃতিদের ছোঁড়া একটিও গুলিও স্পর্শ করে না। গুলিবিদ্ধ দু’জনকে উদ্ধার করে ঘটনাস্থলের অদূরের অনাময় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা রাজু ঝাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ের বাম হাতে অস্ত্রোপচার হয় বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
গরু পাচারকারী আব্দুল লতিফের গাড়ির চালক সেখ নূর হোসেন ঘটনার দিন অর্থাৎ ১ এপ্রিল রাতেই শক্তিগড় থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। যে অভিযোগ পত্র সোমবার সকালে প্রকাশ্যে আসে। তাতে দেখা যায় নুর পুলিশকে জানিয়েছেন, প্রতিদিন সকালের মত শনিবার সকাল ৮ টায় তিনি ইলামবাজারে মালিক লতিফের বাড়িতে যান। ওইদিন আনুমানিক বেলা দেড়টা নাগাদ মালিক লতিফকে গাড়িতে চাপিয়ে দুর্গাপুরের দিকে রওয়ানা দেন। দুর্গাপুরের ভিড়িঙ্গি মোড়ে গাড়িতে তোলা হয় ব্রতীন মুখোপাধ্যায়কে। এরপর গাড়ি চালিয়ে তিনি দুর্গাপুর সিটি সেন্টারে এসে পৌছান। সেখানে রাজু ঝার ফরচুন হোটেলের কাছে ব্রতীন ও লতিফ দু’জনই গাড়ি থেকে নেমে যান। রাজু ঝা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সূত্রের খবর, নুর পুলিশকে জানিয়েছেন যে- ওইদিন সন্ধ্যে ৬.১০ নাগাদ হোটেলের সামনে থেকে তিন জনকে তাঁর গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে ফের রওনা দেয়। তারা কলকাতার দিকে যাচ্ছিলেন।
এরপর রাজু ঝায়ের কথামত শক্তিগড়ের ল্যাংচা হাবে গাড়ি দাঁড়ার করান। তখন আনুমানিক সময় সন্ধ্যা ৭.৩৫ মিনিট হবে। ওখানেই রাজু ছাড়া সকলেই গাড়ি থেকে নামেন। তাঁরা সকলেই ঝালমুড়ি কেনেন। এরপর সবাই গাড়িতে ওঠেন। তার পর ব্রতীন মুখোপাধ্যায় তাকে রজনীগন্ধা, গুটখা কিনে আনতে বলেন। নূর জানিয়েছেন, তিনি যখন রজনীগন্ধা গুটখা কিনে গাড়ির দিকে আসছিলেন তখন দেখেন, তিনজন লোক তাদের গাড়িতে গুলি করছে। নুর এও জানিয়েছেন, এমটা দেখেই তিনি চিৎকার করে লোকজন ডাকা শুরু করেন। এসময় নীল রঙের একটি গাড়ি চেপে কিলাররা কলকাতার দিকে পালিয়ে যায়।ওই সময় থেকেই গাড়ির মালিক আব্দুল লতিফ কে আর তিনি দেখতে পাইনি। এসময় পুলিশ আসে। পুলিশ এলে তিনি গাড়ি চালিয়ে অনাময় হাসপাতালে যান। সেখানেই ডাক্তাররা রাজু ঝাকে মৃত ঘোষণা করেধ। আহত ব্রতীনের হাতে গুলি লাগায় তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়।।
নুর হোসেনের দায়ের করা এই অভিযোগ ঘিরে যখন তোলপাড় পড়ে যায়। শক্তিগড় থানায় পৌছায় গাড়ি বিশেষজ্ঞ দল। তারা আব্দুল লতিফের গাড়ি ও পুলিশের উদ্ধার করা একটি নীল গাড়িতে পরীক্ষা নিরিক্ষা চালায়। এরই মধ্যে এদিন দুপুরে বর্ধমান হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর ব্রতীন মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার পুলিশ সুপারের অফিসে। নুর হোসেনকেও সেখানে হাজির করা হয়। জেলা পুলিশ সুপার কামনাশিস সেনের উপস্থিতিতে প্রথমে দু’জনকে আলাদা আলাদা জিঞ্জাসাবাদ করা হয়। পরে দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। জিজ্ঞাসাদে খুনের ঘটনার নেপথ্য কারণ কিছু উঠে আসল কিনা বা আততায়ীদের বিষয়ে কিছু জানা গেল কিনা সেই ব্যাপারে পুলিশ সুপার কিছু স্পষ্ট করেন নি। পুলিশ সুপার শুধু বলেন , 'তদন্ত জারি রয়েছে। শিট গঠন করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে যাদের যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন রয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খুব শিঘ্র একটা ব্রেক থ্রু পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।' তবে সূত্রের খবর, নুর ও ব্রতীনের বয়ানে বিস্তর অসঙ্গতি মিলেছে। বর্তীন মুখোপাধ্যায় নাকি জানিয়েছেন, তিনি আব্দুল লতিফকে চেনেন না।