Advertisment

এক খুদে বিজ্ঞানীর কাহিনী, যা পড়লে চমকে যাবেন

আগামী ৩ ডিসেম্বর ১৫ বছর পূর্ণ করে ১৬-তে পড়বে বর্ধমানের মেমারির দিগন্তিকা। প্রচেষ্টা ও লক্ষ্য় স্থির থাকলে কী যে করা যেতে পারে তা প্রমাণ করে দিয়েছে সে। বিজ্ঞানী হিসাবেই প্রতিষ্ঠা চায় দশম শ্রেণির ওই ছাত্রী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

দিগন্তিকা বসু।

খুদে বিজ্ঞানী দিগন্তিকা বসু। বছর পনেরোর দিগন্তিকার একাধিক প্রকল্প সসম্মানে উতরে গিয়েছে। দিনে দিনে বাড়ছে আবিষ্কারের সংখ্য়া। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্য়ে একাধিক পুরস্কারে ইতিমধ্যে সম্মানিতও হয়েছে সে। তাছাড়া বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দশম শ্রেণির এই ছাত্রী। এখন তার গবেষণার বিষয়, প্রবীণরা একা বাড়ির বাইরে বের হলে কী ভাবে নিরাপদে থাকবেন। ২০১৭-এর পর এবারও দ্বিতীয়বারের জন্য় মনোনীত হয়েছে এপিজে আব্দুল কালাম ইগনাইট অ্য়াওয়ার্ডের জন্য়। পূর্ব বর্ধমানের মেমারির সুলতানপুরে তার পড়াশুনা করার ঘরটাকেই আস্ত একটা গবেষণাগার বানিয়েছে।

Advertisment

পড়াশুনা, আবিষ্কার ও আঁকা এই নিয়ে দিগন্তিকার পৃথিবী। নতুন কিছু আবিষ্কারের কথা সে প্রথম ভেবেছিল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের প্রকল্প নিয়ে বড়দের বিভাগে প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে তৃতীয় হয়েছিল। সেই শুরু তার বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনা। নতুন নতুন গবেষণা। ১৫ বছরের মধ্য়েই তার ভাঁড়ারে অনেক কিছু স্থান করে নিয়েছে। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দও তাঁর গবেষণায় মুগ্ধ। বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় আরও এগিয়ে যেতে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।

publive-image দিগন্তিকার আবিষ্কার

ইমন, দেবারতি, কুচুম নানা ডাক নাম রয়েছে আদরের দিগন্তিকার। শুভ্রা বসুর আদরের কুচুমের কাছে কি ভাবে বিজ্ঞান এতটা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল? কী বলছে সে? মেমারি রসিকলাল বালিকা বিদ্য়ালয়ের দশম শ্রেণির এই ছাত্রীর কথায়, “আমার ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রতি আগ্রহ ছিল। একেবারে ছোট বয়সে তৃতীয় হওয়ার পর সেই আগ্রহ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের প্রকল্পই আমাকে গবেষণা করতে শিখিয়েছে। এখন চোখের সামনে সমস্য়া দেখলেই সমাধান করার কথা ভাবি। লক্ষ্য় মাধ্য়মকিকে ভাল ফল করা। তারপর সায়েন্স নিয়ে পড়ব। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করাই আমার নেশা।’’

এখনও অবধি তার আবিষ্কারের তালিকায় কী কী রয়েছে? ২০১৬ সালে সে আলোকের প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে একটা চশমা তৈরি করে। ওই চমশা পড়লে কোনও মুভমেন্ট না করেও ১৫ ডিগ্রি বাদ দিয়ে বাকি ৩৪৫ ডিগ্রি দেখা যাবে। পিছনের অংশ সবটাই দেখা যাবে। স্বাভাবিক ভাবে পিছনের ১৫ ডিগ্রি বাদ যায়, তবে ঘাড় একটু কাত করলে সবটা চোখের গোচরে চলে আসবে। কী ভাবে মাথায় এল এই চশমা তৈরি ভাবনা? দিগন্তিকার বাবা সুদীপ্ত বসুর মেমারিতে ইলেক্ট্রনিক্সের ব্য়বসা। তিনি বলেন, “আমরা একবার সপরিবারে সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে যাঁরা জঙ্গলে কাঠ, মধু সংগ্রহ করতে যায়, তাঁদের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের কাহিনী প্রত্য়ক্ষ করেছিল মেয়ে। কী ভাবে বাঘের ভয়ে পিছনে মুখোশ পরেন তাঁরা। যা কয়েকশো বছরেও বদল হয়নি। সেই সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার সময় তার মাথায় এই চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। ওকে বিষয়টা ভাবায়। পিছনের দিকে না ঘুরেও কীভাবে দেখা যায়।’’ দিগন্তিকা বলে, “কোনও সমস্য়া দেখলেই তা সমাধান করার জন্য় আমি চিন্তা করতে থাকি। উপায় যে আমাকে বের করতেই হবে।’’

আরও পড়ুন, বিপদ আসার আগেই জানান দেবে ডিভাইস, গবেষণায় বাঙালি বিজ্ঞানী

ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এন্ড টোকনেলজি গভর্মেন্ট অব ইন্ডিয়ার অধিনস্ত ন্য়াশনাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশন ইন্ডিয়া দিগন্তিকার আবিষ্কারের বিষয়টা জানতে পারে। পূর্বাঞ্চলে এদের অফিস ওড়িশাতে। তারা বর্ধমান সায়েন্স সেন্টারে যোগাযোগ করে। সেখান থেকে জোগাড় হয়ে যায় সুদীপ্ত বসুর মোবাইল নম্বর। ওদের কাছে সুদীপ্তবাবুর মোবাইল নম্বর ছিল। তারপর ওরা যোগাযোগ করে ২০১৭-এর সেপ্টেম্বরে সুলতানপুরে সুদীপ্তবাবুর বাড়িতে হাজির হয়। তিনি বলেন, “ওড়িশা থেকে এক আধিকারিক আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তারপর স্কুলেও গিয়েছিলন। মেয়ের চশমার প্রকল্প দেখে অভিভূত হয়ে যান তিনি। পাশাপাশি, ডাস্ট কালেক্টিং অ্য়াটাচমেন্ট ফর ড্রিল মেশিন প্রকল্প নিয়ে মেয়ে কাজ করে। ওই প্রকল্পেও তাঁরা খুব আগ্রহ দেখান। তাঁরা আমাদের বলে যান আপডেট হলে আমাদের জানাবেন।’’ আমরা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতাম। তাঁর কথায়, “আমরা তো জানতাম না। ওঁরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জাতীয় পুরস্কারের জন্য় আবেদন করেন দিগন্তিকার হয়ে। ২০১৭ তে এপিজে আব্দুল কালাম ইগনাইট অ্য়াওয়ার্ডে মেয়ে মনোনীত হয়।’’

কী আবিষ্কার করেছে সে? ড্রিল করার সময়ে কাঁপুনি হয়। সেই কাঁপুনিকে শক্তি হিসাবে ব্য়বহার করে ড্রিল করে যে ধুলো হয় তা একটা চেম্বারে জড় করে দেবে ওই মেশিন। ড্রিল করার পর যে ধুলোবালি নোংরা করে দেয় তা হবে না। ডাস্ট অ্য়ালার্জির জন্য় যাঁরা এ কাজ করতে পারেন না, তাঁরাও করতে পারবেন। ড্রিল মেশিনে অ্য়াটাচমেন্ট করতে খরচ মাত্র ২৫০ টাকা। ওই প্রকল্পের জন্যেই পুরস্কৃত হয়েছে দিগন্তিকা অ্য়াওয়ার্ড পায়। ন্য়াশনাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশন ইন্ডিয়া আগ্রহ দেখায়। ওই প্রকল্পের জন্য় পেটেন্ট অ্য়াপ্লাই করা হয়েছে। প্রোভিশনাল পেটেন্টও পাওয়া গিয়েছে বলে জানালেন দিগন্তিকার বাবা।

এখানেই দিগন্তিকার গল্প শেষ নয়। তাঁর বাবা জানান, এই বিভাগের মন্ত্রী হর্ষ বর্ধনও দিগন্তিকার কাজে আগ্রহ দেখান। তাঁদের আগ্রহে চলতি বছরে রাষ্ট্রপতি ভবনে ১৯-২৩ মার্চ ফেস্টিভেল অভ ইনোভেশন এন্ড ইন্টারপ্রেনারশিপে অংশ নেয় মেয়ে। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নিজে দিগন্তিকার প্রোজেক্ট দেখেন ও তাঁকে উৎসাহিত করেন।

এবার ফের এপিজে আব্দুল কালাম ইগানাইট পুরস্কার পেতে চলেছে দিগন্তিকা। এবার সে আবিষ্কার করেছে স্মার্ট সার্ভিক্য়াল কলার। স্পন্ডেলাইটিস রোগীদের কষ্টের কথা ভেবে এই আবিষ্কার। তার ষাটোর্দ্ধ ঠাকুমা লক্ষ্মীপ্রিয়া বসুর সার্ভিক্য়াল স্পন্ডেলাইটিস আছে। তাঁকে কলার পরতে দিয়েছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী তা ব্য়বহার করতে চাইতেন না। ওই কলার পরলেই ভিতরে ঘাম হয়ে সমস্য়া দেখা দিত। বিষয়টি লক্ষ্য় করে দিগন্তিকা। তার মাথায় ঘুরতে থাকে কিভাবে এর সমাধান করা যায়। তার বদ্ধমূল ধারণা হল তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার জন্য়ই এই অসুবিধা হচ্ছে। এদুটি নিয়ন্ত্রণ করলেই আরামদায়ক হতে পারে সার্ভিক্য়াল কলার। তখন সে চিন্তা করল বারনৌলির সূত্র ও এয়ার ফ্লো ব্য়বহার করে বাইরের ও কলারের ভিতরের তাপমাত্রা এক রাখা যাবে। এমনকী রেগুলেটরের মাধ্য়মে নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। দিগন্তিকা তৈরি করে ফেলে স্মার্ট সার্ভিক্য়াল কলার। সুদীপ্তবাবু জানান, ওই আবিষ্কৃত কলার চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে রোগীদের ১০ টা ফোটোটাইপ দেওয়া হয়। ৩-৪ মাস ধরে চলে গবেষণা। একটু আধটু যে সমস্য়া ছিল তা কাটিয়ে ওঠা যায়। এবারও এপিজে আবদুল কালাম ইগনাইট পুরস্কারে জন্য় আবেদন করা হয়। ওই কলারের সৌজন্য়েই সেখানে নির্বাচতি হয়েছে দিগন্তিকা। এবার সেখানে প্রোজেক্টের সংখ্য়াও কমে গিয়েছে। সারা দেশে সব মিলিয়ে ২১ টা প্রোজেক্টকে নির্বাচিত করা হয়েছে। প্রতিযোগীর সংখ্য়া ৩১।

কেন্দ্রীয় সরকারের যুব সায়েন্টিস্ট প্রতিনিধি হিসাবে ৫-৮ সেপ্টেম্বর লখনউতে এক বিজ্ঞান ভিত্তিক অনুষ্ঠানে সে যোগ দিয়েছে। দিগন্তিকা বিদেশ যাওয়ারও সুযোগ পেয়েছিল। জাকার্তায় ইন্ডিয়ান এশিয়ান ইনোভেশন ইউথ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে। ওই প্রোগ্রামেও তাকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচিত করা হয়েছিল। কিন্তু ৭ দিন আগে যোগ দিতে বলায় সম্ভব হয়নি। সুদীপ্তবাবু জানান, পাসপোর্ট ছিল না, তাই যাওয়া হয়নি। এখন পাসপোর্ট করার তোড়জোড় চলছে।

সমাজে আরও যে সমস্য়া রয়েছে তার সমাাধান করা নিয়েই ভাবছে দিগন্তিকা। নতুন কিছু সৃষ্টি করার ভাবনা রয়েছে তার, যাতে সার্বিকভাবে সমাজের উপকার হয়। ২০১৯-এর মাধ্য়মিক পরীক্ষার্থী বলে, “ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয়, আমার বিজ্ঞানী হওয়ার ইচ্ছা। রিসার্চ ওয়ার্ক করতে চাই। বাবার কাজ-কর্ম আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে। মা-ও খুব সাহায্য় করেছে। আব্দুল কালাম আমার প্রথম অনুপ্রেরণা।’’ দিগন্তিকা নিজের স্কুল ও বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য়ের কথাও ভুলতে নারাজ। তার লক্ষ্য়, পড়াশুনা ছাড়া রিসার্চ আর ড্রয়িং করা।

এখন তার ভাবনা, বৃ্দ্ধ মানুষেরা বাইরে বেরোলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তখন কী করে অ্য়াম্বুলেন্স বা বাড়ির লোক খবর পাবে। তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবছেন। সেই নিয়ে এখন গবেষণা করছে দিগন্তিকা। সে চাইছে, একটা রিস্ট ব্যান্ড আবিষ্কার করতে। প্রবীণদের হাতে সেই ব্য়ান্ড থাকবে। হার্ট বিট বেড়ে গেলে বা কমে গেলে ওই ব্য়ান্ডের মাধ্য়মে সেই তথ্য় চলে যাবে নির্দিষ্ট কিছু ফোন নম্বরে। সেখানে বাড়ির নম্বর থাকবে, চিকিৎসা বা জরুরি পরিষেবা সংক্রান্ত নম্বর থাকবে। এসএমএস পৌঁছে যাবে ওই সব নম্বরে। অর্থাৎ আলাদা করে ফোন করে জানানোর দরকার পড়বে না। ভাবনা তার থেমে নেই। সে এরই মধ্য়ে ভাবছে হাতে ব্য়ান্ডেজ হলে ভিতরে যে চুলকানি হয় তা কীভাবে আটকানো যায়।

science
Advertisment