Advertisment

কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া রাজু ঝা খুনে দানা বাঁধছে রহস্য, 'চতুর্থ ব্যক্তি' কে?

এই কয়লা মাফিয়ার সঙ্গে গরু পাচারকারী ফেরার আবদুল লতিফের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Car

এই নীল গাড়িতে চেপেই দুষ্কৃতীরা এসেছিল বলে সন্দেহ পুলিশের। (ডানদিকে) মোবাইল হাতে এই ব্যক্তিই সন্দেহের তালিকায়।

সিবিআই, ইডির কয়লা পাচার ও গরুপাচার তদন্তের মাঝপথেই আততায়ীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া রাজু ঝা (৫২)। শনিবার রাত ৮টা নাগাদ এই শুটআউটের ঘটনাটি ঘটেছে পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড়ে কলকাতা মুখী ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ল্যাংচার দোকানের সামনে। নীল রঙের একটি দামি চারচাকা গাড়িতে চেপে আসা দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে মৃত্যু হয়েছে সাদা রংয়ের ফরচুনা গাড়িতে সওয়ার কয়লা মাফিয়া রাজু ঝার। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখম হয়েছেন একই গাড়িতে থাকা রাজুর সহযোগী ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর বাম হাতে গুলি লেগেছে। অস্ত্রোপচারের পর ব্রতীন এখন বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

Advertisment

তবে এত কিছুর মধ্যেও আশ্চর্যজনকভাবে দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলির একটিও স্পর্শ করেনি ফরচুনা গড়ির চালক নুরুল হোসেন ওরফে নুরকে। এই বিষয়টি পুলিশকেও ভাবিয়ে তুলেছে। ১২ সদস্যের বিশেষ তদন্ত কমিটি (সিট) গঠন করে পুলিশ রাজু ঝা খুনের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। সিআইডি আলাদা ভাবে এই খুনের ঘটনার তদন্ত শুরু করবে কি না, সেই বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। তবে সূত্রের খবর, সিবিআই ও ইডি রাজু ঝা-র খুন হওয়ার ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে।

এদিকে এই শুটআউটের ঘটনায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে শক্তিগড়ে জাতীয় সড়কের ধারে থাকা ব্যবসায়ী মহলে। যে খাবারের দোকানগুলোর সামনে শনিবার রাতে শুটআউটের ঘটনা ঘটে, সেই দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা রবিবার মুখে কুলুপ এঁটেছেন। রবিবার ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা গেল, ঘটনাস্থল ও তার থেকে ফুট ২০-২৫ দূরে রক্তের দাগ। মূল ঘটনাস্থল ছাড়াও ওই জায়গাটি ব্যারিকেড করে রেখেছে পুলিশ।

শনিবার রাতেই ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকটি গুলির খোল উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা। রবিবার সন্ধ্যায় ফরেনসিক টিম ঘটনাস্থলে তদন্তে আসে। তদন্তকারীরা ঘটনাস্থল খুঁটিয়ে দেখেন। ঘটনাস্থল থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন। ফরেনসিক দলের সদস্যরা জানিয়েছেন, মোট ১৩টি গুলির খোল উদ্ধার হয়েছে। আততায়ীরা যে গাড়িটি লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল, সেই গাড়িটিও পরীক্ষা করা হবে বলেই ফরেনসিক দলের সদস্যরা জানিয়েছেন।

ঘটনার পরে জাতীয় সড়ক ও তার আশপাশের সমস্ত সড়কপথে নাকা চেকিংয়ে নামে জেলার বিভিন্ন থানার পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে ঘটনাস্থলের একাধিক দোকানের সিসিটিভির হার্ড ডিস্ক পুলিশ সংগ্রহ করেছে। আততায়ীদের খোঁজ পেতে পুলিশ ফরচুনা গাড়ির চালক নুরুল হোসেন ছাড়াও ঘটনাস্থলে থাকা আবুজিয়া শেখকে শক্তিগড় থানায় বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও পুলিশ কর্তারা কথা বলেছেন।

শনিবার অনেকটা রাতে ঘটনাস্থলে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে জেলার পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন জানিয়েছিলেন, ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু হয়েছে। আততায়ীদের ধরার চেষ্টা চলছে। আততায়ীরা ধরা পড়বেই বলে পুলিশ সুপার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু, ঘটনার ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পরেও পুলিশ আততায়ীদের কারও টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি।

এরই মধ্যে শনিবার গভীর রাতে ঘটনাস্থল থেকে আনুমানিক ৩ কিলোমিটার দূরে এবং শক্তিগড় থানা থেকে ৫০০ মিটার দূরে পুরোনো জিটি রোডের ওপরে যাত্রীবিহীন নীল রংয়ের একটি দামি চারচাকা গাড়ির হদিশ পায় পুলিশ। সেই গাড়ির ভিতর থেকে পুলিশ গেরুয়া রঙের একটি উত্তরীয়, কিছু কার্তুজ ও একটি আগ্নেআস্ত্র পেয়েছে বলেই স্থানীয়রা দাবি করেছেন। তবে, পুলিশ কর্তারা এই বিষয়ে রবিবার কিছু খোলসা করেননি। রবিবারই বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ মর্গে রাজু ঝার দেহের ময়নাতদন্ত হয়। তাঁর পরিবারের লোকজন মর্গে উপস্থিত ছিলেন। হাসপাতাল সূত্রে খবর, রাজু ঝার শরীরে ছয়টি গুলি লেগেছে।

শক্তিগড়ে জাতীয় সড়কের দু'ধারে রয়েছে ল্যাংচা-সহ অন্যান্য মিষ্টি বিক্রির একাধিক দোকান। সন্ধ্যার পর দূর-দূরান্তে যাতায়াত করা গাড়ির আরোহীরা ওইসব ল্যাংচার দোকানে দাঁড়িয়ে খাওয়া-দাওয়া সারেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, শনিবার রাত ৮টা নাগাদ কলকাতামুখী রোডে শক্তিগড়ের একটি ল্যাংচা দোকানের সামনে দাঁড়ায় সাদা রংয়ের একটি ফরচুনা গাড়ি। ওই গাড়ির আরোহীরা, গাড়ি থেকে নামতে না-নামতেই, নীল রঙের একটি চারচাকা গাড়ি এসে সেখানে দাঁড়ায়।

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলচে রঙের গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে একেবারে শার্প শুটারের কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই ফরচুনা গাড়ির আরোহীদের লক্ষ্য করে পরপর গুলি চালায়। গুলি চালিয়েই নীলচে রঙের গাড়িতে চেপে দুষ্কৃতীরা দ্রুত কলকাতামুখী রোড ধরে পালিয়ে যায়। ওই নীল চারচাকা গাড়ির আগে আগে একটি বাইকে চেপে তিন যুবক যাচ্ছিল। বাইক আরোহীরা নীল গাড়িটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

ঘটনাস্থলে দোকানে কাজ করা এক কর্মী রবিবার দাবি করেন, পরপর গুলি ছোড়ার আওয়াজ তাঁরা পান। তাঁর মতে কমবেশি ৯-১০ রাউণ্ড গুলি চালায় দুষ্কৃতীরা। গুলিতে ফরচুনা গাড়ির চালকের পাশের সিটে বসে থাকা ব্রতীন মুখোপাধ্যায় এবং পিছনের আসনে বসে থাকা রাজু ঝা গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে দুষ্কৃতীদের ছোড়া একটিও গুলি ফরচুনা গাড়ির চালককে স্পর্শ করেনি। গুলিবিদ্ধ দু’জনকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলের অদূরে অনাময় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা রাজু ঝাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

দুষ্কৃতী হামলার শিকার ফরচুনা গাড়িক চালক নুর হোসেন রাতে জানান, তাঁরা দুর্গাপুর থেকে কলকাতা যাচ্ছিলেন। শক্তিগড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তিনি ঝালমুড়ি আনতে যাচ্ছিলেন। তবে তাঁদের গাড়িতে ক'জন আরোহী ছিল এবং তাঁদের পরিচয় নিয়ে কিছু বলতে চাননি ফরচুনা গাড়ির চালক। এর খানিক পরেই ঘটনাস্থল থেকে ২০-২৫ ফুট দূরে রক্তের দাগ দেখতে পাওয়ার পর সবাই ধরে নেন, গাড়িতে চতুর্থ কোনও ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।

গুলিতে জখম হবার পর গাড়ি থেকে নেমে ওই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে ওই ব্যক্তি গা ঢাকা দিয়েছেন বলেই সবাই ধরে নেন। পরে ফরচুনা গাড়ির নম্বর ধরে খোঁজ চালিয়ে জানা যায়, ওই গাড়ির মালিক হলেন সিবিআইয়ের তদন্তাধীন গরু পাচার মামলায় অন্যতম ফেরার অভিযুক্ত আবদুল লতিফ। উধাও হয়ে যাওয়া চতুর্থ ব্যক্তিই আবদুল লতিফ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও পুলিশ ফরচুনা গাড়িতে চতুর্থ ব্যক্তির উপস্থিতি স্বীকার করছে না।

আরও পড়ুন- সিপিএমের সময়ে উত্থান ‘মাফিয়া’ রাজুর, একুশে যোগ দিলেও বিজেপিতে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি!

রাজু ঝার মৃত্যুর কারণ গ্যাং ওয়ার, নাকি পরিকল্পনা করে খুন, তা এখনও রহস্যই রয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে একতরফা গুলি চলেছে। কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া হিসেবে পশ্চিম বর্ধমান জেলায় পরিচিত রাজু ঝা। প্রথমে কয়লাবাহী গাড়ির খালাসির কাজ করতেন। তার পর ধীরে ধীরে কয়লা মাফিয়া ডন হয়ে ওঠেন। বাম আমলে তার কারবারের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ে। দুর্গাপুর, আসানসোল থেকে শুরু করে ডানকুনি- সর্বত্র কয়লা পাচারের মাধ্যম ছিল রাজুর প্যাড। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজু ঝা হোটেল, আবাসন ও বিলাসবহুল বাসের ব্যবসায় নামে। তবে তাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েই গিয়েছিল।

বিভিন্ন থানায় রাজু ঝার নামে অভিযোগ জমা ছিল। সিআইডি ইতিপূর্বে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে রাজু ঝা বিজেপিতে যোগ দেন। কয়লা পাচার নিয়ে এখন সিবিআই ও ইডি যে তদন্ত চালাচ্ছে, তার স্ক্যানারেও ছিল রাজু ঝা। সূত্রের খবর, কয়লা মাফিয়া রাজু ঝার সঙ্গে আবদুল লতিফ এবং এনামুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রাজু তদন্তকারী সংস্থার কাছে সত্য কবুল করলে অনেক প্রভাবশালী কি ফেঁসে যেতে পারতেন? সেই প্রশ্নই এখন এই হত্যারহস্যে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

police Murder Coal Smuggling Case
Advertisment