Advertisment

২২০ রকমের ধান, ১৩০ প্রজাতির ডিম, আর কী আছে এই শিক্ষকের সংগ্রহে?

অমরেশবাবুর কাছে রয়েছে ২২০ প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া ধান। ১৩০ রকমের পাখির ডিম। তিনশোরও বেশি কলমের সংগ্রহ- খাগের কলম থেকে শুরু করে ১৯২৪ সালে বার্মিংহামে তৈরি হওয়া নিব! রয়েছে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য ডাকটিকিট আর হরেক রকমের পাথরের সংগ্রহ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

শতাব্দীপ্রাচীন খাগের কলম হাতে নিজের বাড়িতে অমরেশ মিত্র

বয়স ৮২ পেরিয়েছে। সর্বাঙ্গে গ্রাস করেছে জরা। ভাল করে হাঁটতে পারেন না। কথা বলতেও সমস্যা হয়। কিন্তু তাতে থোড়াই কেয়ার। কৃষ্ণনগরের বাগানঘেরা ছোট্ট বাড়িতে বসে অমূল্য সম্পদ আগলাচ্ছেন বৃদ্ধ অমরেশ মিত্র।

Advertisment

কী সেই সম্পদ? অমরেশবাবুর কাছে রয়েছে ২২০ প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া ধান। সবুজ বিপ্লব এবং উচ্চফলনশীল ধানের দাপটে যেগুলি এখন হয় বিলুপ্ত অথবা বিলুপ্তপ্রায়। পাশাপাশি রয়েছে ১৩০ রকমের পাখির ডিম। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের তিনশোরও বেশি কলমের সংগ্রহ। খাগের কলম থেকে শুরু করে ১৯২৪ সালে ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে তৈরি হওয়া নিব - কী নেই! রয়েছে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য ডাকটিকিট আর হরেক রকমের পাথরের সংগ্রহ।

অমরেশবাবু পেশায় ছিলেন শিক্ষক। আমঘাটা শ্যামপুর হাইস্কুলে দীর্ঘ ৪২ বছর পড়িয়েছেন। কিন্তু ছোট থেকে মাথায় ভর করেছিল সংগ্রহের নেশা। জানালেন, শুরুটা একদম ছোটবেলায়। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বিভিন্ন পাখির ডিম সংগ্রহ করে আনতেন। সযত্নে কৌটোয় ভরে রেখে দিতেন। কৌটোর গায়ে লেখা থাকত পাখির নাম। তাঁর কথায়, "আমাদের বাংলায় যা সব পাখি রয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকের ডিম আমার সংগ্রহে রয়েছে। এখন তো মোবাইল টাওয়ারের দৌলতে অনেক প্রজাতির পাখি বিপুল হ্রাস পেয়েছে। আগে আরও অনেক ধরনের পাখি দেখতাম। আমাদের বাগানেও তারা আসত, ডিম পাড়ত। আমি সংগ্রহ করে রাখতাম। এর বাইরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় জেলায় ঘুরে ডিম সংগ্রহ করেছি। উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায় কয়েকটি বিশেষ প্রজাতির পাখি আসত, যাদের নদীয়া বা দক্ষিণবঙ্গে তেমন পাওয়া যেত না। তাদের ডিমও আমার কাছে রয়েছে। কেবল বাংলা নয়, সংগ্রহের নেশায় ভিনরাজ্যেও পাড়ি দিয়েছি। বিশেষত ওড়িশা চিল্কা থেকে থেকে বেশ কিছু প্রজাতির পাখির ডিম পেয়েছি।"

publive-image শতাধিক পাখির ডিম

তবে ডিম নয়, অমরেশবাবুর অমূল্য সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে নজর কাড়ে ২২০ রকমের ধানের ছড়া! বৃদ্ধ অনর্গল একের পর এক ধানের নাম বলে যাচ্ছিলেন। চিংলিভূষি, বৌপাগলা, হনুমানজটা। এগুলি হল আউশ ধানের অসংখ্য প্রকারভেদের কয়েকটি। আমন ধানের মধ্যে রয়েছে সরুসেঠে, মেটেজাবলি, শোলকলমা। আরও অসংখ্য। জলকলমি, রেশমি, পাথরকুচির মতো ধানগুলি বোরো ধানের হরেক প্রজাতির কয়েকটি। কী করে সংগ্রহ করলেন এত রকমের ধান! অমরেশবাবু বলেন, "কষ্ট করতে হয়েছে অনেক। দুর্লভ কোনও ধানের খোঁজ পেতেই নাওয়াখাওয়া ভুলে ছুটে গিয়েছি সেখানে। একের পর জেলায় গিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। কৃষক পরিবারের সঙ্গে থেকেছি। এভাবেই আস্তে আস্তে বেড়েছে সংখ্যাটা। তারপর একসময় ২০০ পবেরিয়ে গিয়েছে।"

অমরেশবাবুর বসার ঘরের দেওয়াল জুড়ে আলমারি। সেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে ধানের ছড়া। প্রতিটির গায়ে কাগজ দিয়ে লেখা রয়েছে প্রজাতির নাম। বৃদ্ধের কথায়, "ধান সংগ্রহ ও ধানের ছড়াগুলি সংরক্ষণ করে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি। কারণ লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সরকার উচ্চফলনশীল ধান চাষে জোর দেয়। তাতে উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেশে ধানের যে বৈচিত্র ছিল, তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এরপর আসে সবুজ বিপ্লব। ধানের বৈচিত্র আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমার এই সামান্য সংগ্রহ যদি আর কিছু করতে না-ও পারে, তবু এই ধানগুলোর নাম টিঁকিয়ে রাখবে। সেখানেই আমার তৃপ্তি।"

publive-image এভাবেই সাজানো রয়েছে ধানের ছড়া

প্রাক্তন শিক্ষকের কলমের ভাণ্ডারও তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। খাগের কলম থেকে শুরু করে নামজাদা ব্র্যান্ডের আধুনিকতম মডেল - সব রয়েছে তাঁর কাছে। কার্যত কলমের বির্বতনের ইতিহাসটাই ছবির মতো ফুটে ওঠে অমরেশবাবুর আলমারির সামনে দাঁড়ালে। আর রয়েছে অসংখ্য ডাকটিকিটের সমাহার। তাঁর কথায়, "১৮৫৪ সালের এদেশে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। ওই বছর থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ডাকটিকিটের কয়েকটি আমার কাছে নেই। তবে ১৯০০ থেকে এখনও পর্যন্ত সবকটি ডাকটিকিট আমার সংগ্রহে রয়েছে।"

বয়সের ভারে অমরেশবাবু একটানা কথা বলতে পারেন না। কথা জড়িয়ে যায়। হাঁটতেও সমস্যা হয় তাঁর। কিন্তু সংগ্রহের বিষয়ে কথা উঠলেই মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বৃদ্ধের। বললেন, "এগুলিই আমার সব। যতদিন বাঁচব, এদের নিয়েই বাঁচব।" কিন্তু তিনি যখন থাকবেন না, তখন কী হবে এই বিপুল সংগ্রহের? বৃদ্ধ বলেন, "আমার দুই মেয়ে। দু-জনেই প্রতিষ্ঠিত, বাইরে থাকে। ওরা জানে এগুলি আমার কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। ওরা কথা দিয়েছে আমার এই সম্পদ সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করবে। দেখা যাক কী হয়। কয়েকটি সংস্থার সঙ্গেও কথা চলছে।"

bengal
Advertisment