১০৬ তম জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের আসর গতকাল সমাপ্ত হলো পাঞ্জাবের লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটিতে। মৌলিক গবেষণার জন্য নয়, বিগত কয়েক বছরে বিজ্ঞান কংগ্রেস 'খবর'-এ এসেছে বিতর্কিত সব মন্তব্যের জন্য। এ বছরের ছবিটাও খুব আলাদা কিছু নয়। 'দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে এপিজে আব্দুল কালামের চেয়ে বড় বিজ্ঞানীর সম্মান' দেওয়া থেকে 'কৌরবদের টেস্ট টিউব বেবি' হওয়ার তত্ত্বের জন্য শিরোনামে এল বিজ্ঞান কংগ্রেস।
আরও আছে। প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হল বিবর্তনবাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত দশাবতার তত্ত্ব। দেশ জানল, আইনস্টাইন এবং নিউটনের তত্ত্ব বিভ্রান্তমূলক। পদার্থবিদ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের নাম রাখা হবে নরেন্দ্র মোদীর নামে।
এই প্রসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বিজ্ঞানকর্মী রবীন চক্রবর্তী বললেন, "এ সব দেখে বিস্মিত হচ্ছি, নানা বক্তব্য নিয়ে এখন সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, ওই মঞ্চ থেকে কোনো প্রতিবাদ হল না কেন? আমরা যারা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা জাগাতে চাই, তাদের জন্য এরকম ঘটনা খুব হতাশাজনক। কারণ আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের চেয়ে যাঁদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি, তাঁরা এই কথাগুলো বলছেন। যার ফলে আমাদের সব প্রচেষ্টা এক লহমায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই কথাগুলো তো কম করেও ১ কোটি লোক পড়ে ফেলেছেন। এবার এঁরা আমাদের কাজ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবেন।"
আরও পড়ুন, ব্রহ্মাণ্ড থেকে সমাজ, বিজ্ঞান যেখানে যেমন; আলোচনায় ডঃ সব্যসাচী সিদ্ধান্ত
অধ্যাপক চক্রবর্তী আরও বলেন, "এসব মন্তব্য তো আর অজ্ঞতা থেকে বলা নয়। অত্যন্ত সুচারু উপায়ে বলেছেন। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। যারা বলছেন, তাঁদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কেউ নিজে বিজ্ঞানী।"
বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চাকারী আশীষ লাহিড়ী বিজ্ঞান কংগ্রেস নিয়ে তাঁর মতামত জানালেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে। বললেন, "জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে তো আজ থেকে এরকম মন্তব্য বলা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরেই আরএসএস এবং বিজেপি মিলিতভাবে চেষ্টা করত হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের। সেটা এতটা খোলাখুলি করত না, এখন প্রকাশ্যে শুরু করেছে। সমাজ কতটা এগোল তা যাচাই করার অন্যতম মাপকাঠি যেহেতু বিজ্ঞান, তাই এখন মানুষকে বিশ্বাস করানো হচ্ছে প্রাচীন যুগে হিন্দুরা সব করে গিয়েছে। এমনকী পাশ্চাত্য সভ্যতা বিজ্ঞানের জগতে যে সমস্ত কৃতিত্বের অধিকারী, সেগুলো আসলে তারও আগে হিন্দুরাই আবিষ্কার করেছিলেন, খানিকটা এ ধরনের প্রচার চালানো হচ্ছে। আর সবচেয়ে আপত্তির জায়গা, বিজ্ঞানে ভারতের যা অবদান রয়েছে, তা সত্যিই অনস্বীকার্য, কিন্তু এঁরা যা প্রচার করছেন তার পেছনে সত্যতা নেই। পুরাণের সঙ্গে বিজ্ঞানকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।"
আশিসবাবু আরও জানালেন, "ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানের জায়গা এখনও তত মজবুত নয়। এ দেশের সংস্কৃতি ধর্মকেন্দ্রিক। তাই এখানে বিজ্ঞান কংগ্রেসের মত মঞ্চে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে যা বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ, যাঁরা বিজ্ঞান এবং দর্শন, দুটোর কোনোটার সম্পর্কেই অবহিত নন, খুব সহজেই সেসব কথা গ্রহণ করে নেন। এই ভিত্তিহীন মন্তব্যের মিছিলে বিজ্ঞানসচেতন মহল তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে এই সব মন্তব্য পাকাপাকি জায়গা করে নিচ্ছে। যুক্তি দিয়ে মানুষের যতটা কাছে পৌঁছনো যায়, আবেগ দিয়ে যায় তার চেয়ে ঢের বেশি। বাড়তি আবেগ দিলে আরও কম সময়েই।
বিজ্ঞান কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রদর্শন, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের সামনে। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
"এটাও মেনে নিতেই হবে, হিন্দুধর্ম দ্বারাই এ দেশের সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে হিন্দুধর্মের একটা হেজিমনি রয়ে গিয়েছে আজও। প্রফুল্ল রায় তাঁর বই 'হিস্ট্রি অব কেমিস্ট্রি'-তে ভারতীয়দের বিজ্ঞান সাধনার উত্থান এবং পতন দুই-ই বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি-ই দেখিয়েছিলেন, সমাজে জাতিভেদ কীভাবে মেধা চর্চা এবং কায়িক শ্রমের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিল। সভাবতই বিজ্ঞানচর্চা সমাজের সব স্তরে পৌঁছল না।
"আরও একটি বিষয়কে দায়ী করেছিলেন প্রফুল্ল রায়। শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ বলল, যা কিছুকে বাস্তব মনে হচ্ছে, তা বাস্তব নয়। এই তত্ত্ব থেকে আমাদের মনে প্রশ্ন আসা কমে গেল। জানার ইচ্ছেটা অনেক কমে গেল। সুতরাং এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট, আমাদের সমাজে বিজ্ঞানের স্থান নড়বড়ে ছিলই বরাবর। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা একই সঙ্গে হাস্যকর এবং বিপজ্জনক।"
জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস: গল্পকথায় মানুষকে বিশ্বাস করানোর রাজনৈতিক প্রচেষ্টা?
"আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের চেয়ে যাঁদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি, তাঁরা এই কথাগুলো বলছেন। যার ফলে আমাদের সব প্রচেষ্টা এক লহমায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।"
Follow Us
১০৬ তম জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের আসর গতকাল সমাপ্ত হলো পাঞ্জাবের লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটিতে। মৌলিক গবেষণার জন্য নয়, বিগত কয়েক বছরে বিজ্ঞান কংগ্রেস 'খবর'-এ এসেছে বিতর্কিত সব মন্তব্যের জন্য। এ বছরের ছবিটাও খুব আলাদা কিছু নয়। 'দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে এপিজে আব্দুল কালামের চেয়ে বড় বিজ্ঞানীর সম্মান' দেওয়া থেকে 'কৌরবদের টেস্ট টিউব বেবি' হওয়ার তত্ত্বের জন্য শিরোনামে এল বিজ্ঞান কংগ্রেস।
আরও আছে। প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হল বিবর্তনবাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত দশাবতার তত্ত্ব। দেশ জানল, আইনস্টাইন এবং নিউটনের তত্ত্ব বিভ্রান্তমূলক। পদার্থবিদ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের নাম রাখা হবে নরেন্দ্র মোদীর নামে।
এই প্রসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বিজ্ঞানকর্মী রবীন চক্রবর্তী বললেন, "এ সব দেখে বিস্মিত হচ্ছি, নানা বক্তব্য নিয়ে এখন সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, ওই মঞ্চ থেকে কোনো প্রতিবাদ হল না কেন? আমরা যারা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা জাগাতে চাই, তাদের জন্য এরকম ঘটনা খুব হতাশাজনক। কারণ আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের চেয়ে যাঁদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি, তাঁরা এই কথাগুলো বলছেন। যার ফলে আমাদের সব প্রচেষ্টা এক লহমায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই কথাগুলো তো কম করেও ১ কোটি লোক পড়ে ফেলেছেন। এবার এঁরা আমাদের কাজ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবেন।"
আরও পড়ুন, ব্রহ্মাণ্ড থেকে সমাজ, বিজ্ঞান যেখানে যেমন; আলোচনায় ডঃ সব্যসাচী সিদ্ধান্ত
অধ্যাপক চক্রবর্তী আরও বলেন, "এসব মন্তব্য তো আর অজ্ঞতা থেকে বলা নয়। অত্যন্ত সুচারু উপায়ে বলেছেন। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। যারা বলছেন, তাঁদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কেউ নিজে বিজ্ঞানী।"
বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চাকারী আশীষ লাহিড়ী বিজ্ঞান কংগ্রেস নিয়ে তাঁর মতামত জানালেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে। বললেন, "জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে তো আজ থেকে এরকম মন্তব্য বলা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরেই আরএসএস এবং বিজেপি মিলিতভাবে চেষ্টা করত হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের। সেটা এতটা খোলাখুলি করত না, এখন প্রকাশ্যে শুরু করেছে। সমাজ কতটা এগোল তা যাচাই করার অন্যতম মাপকাঠি যেহেতু বিজ্ঞান, তাই এখন মানুষকে বিশ্বাস করানো হচ্ছে প্রাচীন যুগে হিন্দুরা সব করে গিয়েছে। এমনকী পাশ্চাত্য সভ্যতা বিজ্ঞানের জগতে যে সমস্ত কৃতিত্বের অধিকারী, সেগুলো আসলে তারও আগে হিন্দুরাই আবিষ্কার করেছিলেন, খানিকটা এ ধরনের প্রচার চালানো হচ্ছে। আর সবচেয়ে আপত্তির জায়গা, বিজ্ঞানে ভারতের যা অবদান রয়েছে, তা সত্যিই অনস্বীকার্য, কিন্তু এঁরা যা প্রচার করছেন তার পেছনে সত্যতা নেই। পুরাণের সঙ্গে বিজ্ঞানকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।"
আশিসবাবু আরও জানালেন, "ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানের জায়গা এখনও তত মজবুত নয়। এ দেশের সংস্কৃতি ধর্মকেন্দ্রিক। তাই এখানে বিজ্ঞান কংগ্রেসের মত মঞ্চে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে যা বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ, যাঁরা বিজ্ঞান এবং দর্শন, দুটোর কোনোটার সম্পর্কেই অবহিত নন, খুব সহজেই সেসব কথা গ্রহণ করে নেন। এই ভিত্তিহীন মন্তব্যের মিছিলে বিজ্ঞানসচেতন মহল তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে এই সব মন্তব্য পাকাপাকি জায়গা করে নিচ্ছে। যুক্তি দিয়ে মানুষের যতটা কাছে পৌঁছনো যায়, আবেগ দিয়ে যায় তার চেয়ে ঢের বেশি। বাড়তি আবেগ দিলে আরও কম সময়েই।
"এটাও মেনে নিতেই হবে, হিন্দুধর্ম দ্বারাই এ দেশের সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে হিন্দুধর্মের একটা হেজিমনি রয়ে গিয়েছে আজও। প্রফুল্ল রায় তাঁর বই 'হিস্ট্রি অব কেমিস্ট্রি'-তে ভারতীয়দের বিজ্ঞান সাধনার উত্থান এবং পতন দুই-ই বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি-ই দেখিয়েছিলেন, সমাজে জাতিভেদ কীভাবে মেধা চর্চা এবং কায়িক শ্রমের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিল। সভাবতই বিজ্ঞানচর্চা সমাজের সব স্তরে পৌঁছল না।
"আরও একটি বিষয়কে দায়ী করেছিলেন প্রফুল্ল রায়। শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ বলল, যা কিছুকে বাস্তব মনে হচ্ছে, তা বাস্তব নয়। এই তত্ত্ব থেকে আমাদের মনে প্রশ্ন আসা কমে গেল। জানার ইচ্ছেটা অনেক কমে গেল। সুতরাং এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট, আমাদের সমাজে বিজ্ঞানের স্থান নড়বড়ে ছিলই বরাবর। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা একই সঙ্গে হাস্যকর এবং বিপজ্জনক।"