কালের বিবর্তনে এমন অনেক রীতি-রেওরাজই আজ অস্তাচলে। গ্রামীণ বাংলার কোনও কোনও এলাকায় প্রাচীন সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার একটি সুপ্ত তাগিদ লক্ষ্য করা গেলেও শহুরে বাঙালির একটা বড় অংশের সেব্যাপারে বেশ অনীহা। আজ থেকে কয়েক দশক আগে পর্যন্তও পয়লা বৈশাখের দিন বাঙালি বাড়িতে নিম-হলুদ মাখা একটা ঐতিহ্যের পরিচায়ক ছিল। নববর্ষের প্রথম দিনে বাড়ির কচিকাচা থেকে শুরু করে বড়রাও গায়ে নিম পাতা ও কাঁচা হলুদ বেটে কিছুক্ষণ রাখার পরেই স্নানে যেতেন। তবে আজ সেসব শুধুই অতীত। ইঁদুর দৌড়ের জীবনে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গেই হারানোর পথে বাঙালির আরও এক সংস্কৃতি।
পয়লা বৈশাখ বাঙালির জীবনে আর পাঁচটা উৎসবের মতোই বেশ আনন্দদায়ক। পুরনো বাংলা বছর শেষে নতুনে পদার্পন। বাংলার নতুন বছর শুরুর এই দিনটিতে গোটা রাজ্যে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এখন তো ডিজিটাল যুগে এই পয়লা বৈশাখের উৎসবের ব্যপ্তি অনেক বেড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বাঙালির বর্ষবরণ পর্ব আজ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ এই দিনে নতুন জামাকাপড় পড়া থেকে শুরু করে পেট পুরে ভুরিভোজ-ঘুরে বেড়ানো…বাদ যায় না কিছুই। ছোটদের সঙ্গে বড়রাও বর্ষবরণের আনন্দে মেতে ওঠেন।
কয়েক দশক আগে পর্যন্তও পয়লা বৈশাখের দিনে অন্যান্য বিস্তর আয়োজনের পাশাপাশি বাঙালি বাড়ির ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়েছিল নিম-হলুদে লেপন। শীল-নোড়ায় কাঁচা হলুদ ও নিম পাতা বেটে তা গায়ে মাখা হতো। বেশ কিছুক্ষণ গায়ে মেখে থাকার পর তা শুকিয়ে যেত। পরে স্নান সেরে একদম ফ্রেশ। পয়লা বৈশাখের দিন এই নিম-হলুদ বাটা মাখার পিছনে একটা বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরের এই সময়টায় বেশ কিছু ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তাই এই সময়ে শরীর সুস্থ রাখতেই নিম-হলুদ বাটা মাখা-তত্ত্ব সামনে আনা হয়। উৎসবের মোড়কে বিষয়টিকে জড়িয়ে আদতে মানবজীবনের কল্যাণের স্বার্থেই এই পন্থার অবলম্বন বলে মত কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের।
আসুন জেনে নিই নিম পাতার গুণাগুণ:
নিম পাতার গুণাগুণ ঠিক লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরা বেশ কঠিন। নিম পাতা অত্যন্ত তেতো। অনেকেই নিমের গুঁড়ো জল দিয়ে খেয়ে ফেলেন। অনেকে নিম পাতা বেটে গায়েও মাখেন। নিম পাতা ভাজা খেলেও যেমন উপকার পাওয়া যায় তেমনই এটি বেটে গায়ে মাখলেও উপকার অনেক। বিশেষ করে ত্বকের রোগ সারাতে নিম পাতার জুড়ি মেলা ভার। অ্যালার্জি, ঘামাচি নাশ করতে নিমের জুড়ি নেই। নিম পাতা পাকস্থলীর জন্যও খুবই উপযোগী। এটি যেমন হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে তেমনই এটি পাকস্থলীকে ঠান্ডা রাখতেও সাহায্য করে।
কাঁচা হলুদের গুণাগুণ:
নিম পাতার মতোই হলুদেরও গুণাগুণ অপরিসীম। কাঁচা হলুদও ত্বক ও পেটের পক্ষে উপযোগী। রক্ত পরিস্কার করতেও এটি বেশ সহায়ক। কাঁচা হলুদ ত্বকের ঔজ্বল্য বাড়াতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। এছাড়াও নানা ধরনের ভাইরাসের হাত থেকেও এটি ত্বককে রক্ষা করে।
পয়লা বৈশাখের দিন নিম পাতা ও কাঁচা হলুদ বেটে গায়ে মাখা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে। তবে এটি ভীষণভাবে বিজ্ঞানসম্মতও বটে। কালের বিবর্তনে আজ এই পর্বটিও বিলুপ্তির পথে। আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছেই এই বিষয়টি একেবারে অজ্ঞাত। কেউ বা জানলেও একটি বড় অংশের পরিবারের বড়দের অনীহায় বিশেষ এই দিনটিতে আগেকার মতো নিম-হলুদ বাটা মাখার রেওয়াজ উঠে গেছে বললেই চলে।