দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা। ২০ মে এই অঞ্চল দেখেছে আমফানের তাণ্ডব। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ধ্বংসের ছবি। এলাকার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাদা-নীল বাড়ি। এটা স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ পাত্রের। ঝড়ে বাড়ির ছাদের টিনের ছাউনির সামান্য ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু, মিলেছে ত্রাণের পুরো টাকা। ধীরেন্দ্রনাথবাবুর পুত্র সহ পরিবারের ৬ সদস্যের পকেটে গিয়েছে সরকারি ত্রাণ ২০ হাজার করে। এছাড়াও মিলেছে একশ দিনের কাজের কর্মীদের বাড়ি মেরামতির নির্ধারিত মূল্যও।
আরেক আমফান বিধ্বস্ত জেলা হাওড়া। সেখানেও একরই ছবি ধরা পড়েছে। পাঁচলা এলাকায় স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সমিতি সদস্য রিম্পা রায়ও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তাঁর পাকা বাড়ির জন্য। কিছু ক্ষতি নজরে এলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু, রিম্পাদেবীর শ্বশুর-শাশুড়ী, স্বামী, ভাই ত্রাণের জন্য আবেদন করতেই ব্যাংকে টাকা পৌঁছে গিয়েছে।
এলাকায় যাঁরা সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত তাঁরা ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। অথচ, ধীরেন্দ্রনাথ পাত্র বা রিম্পা রায়রা ত্রাম পেয়েছেন। কীভাবে সম্ভব? এ সম্পর্কে অবশ্য মুখ খুলে রাজি হননি দু'জনেই।
আমফামের ত্রাণের টাকা নিয়ে ভুরু ভুরি অভিযোগ। ত্রাণের টাকা লুঠ হয়েছে বলে দাবি দুর্গতদের। দক্ষিণবঙ্গজুড়ে হাহাকার, বিক্ষোভ চলেছে। এই অভিযোগের মূলে পৌঁছতে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পৌঁছেছিল পূর্ব মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকায়। সর্বত্রই উপরের দুটি ঘটনার প্রতিফল লক্ষ্য করা গিয়েছে। বেশিরভাগেরই অভিযোগ, শাসক দলের সদস্যরা ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ত্রাণ লুঠেছেন। শুধুই তৃণমূল নয়, যে যেখানে ক্ষমতায় তারাই তখন রাজা হয়েছেন। অথচ গরীব-গুর্বোগুলের অবস্থা বদলায়নি।
পাঁচলার প্ঞ্চায়েত সমিতির সদস্য রিম্পা রায়ের পাশেই স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে বাস জরি শিল্পী নিরঞ্জন রায়ের। বাড়ির মাথার চাল ঝড়ে উড়ে গিয়েছে। বাঁস বেরিয়ে রয়েছে। অথচ ত্রাণের আবেদনেও অর্থ মেলেনি। নিরঞ্জন রায়ের কথায়, 'রিম্পা রায়কে বলা সত্ত্বেও টাকা পাওয়ার তালিকায় আমার নাম দিল না। অথচ ওঁর পরিবারের অনেকে টাকা পেয়ে গেল। বিডিও-র কাছে গিয়ে ফের আরেকবার আবেদন করেছি। এখনও কোনও টাকা আসেনি।'
নিয়ম অনুসারে, বিডিও পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি, বিরোধী দলের সদস্য নিয়ে গঠিত হয় ত্রাণ কমিটি। এঁরাই কারা ত্রাণ পাবেন তা খতিয়ে দেখে দুর্গতদের নাম স্থির করেন। পরে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত সদস্যের অনুমোদনক্রমে ত্রাম মেলে। কমিটির সদস্যদের এলাকায় গিয়ে পরিদর্শন করে এই নাম স্থিত করতে হয়। অভিযোগ, আমফানের পর এইসব কিছুই হয়নি। বিরোধী সদস্যরা জানেনই না কমিটি এলাকা পরিদর্শন করছেন। কিন্তু খাতায় কলমে এই পরিদর্শন হয়েছে। একানেই দুর্নীতির বীজ লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রথমে মুখ না খললেও পাঁচলার গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য রিম্পাদেবীর কথাতেই তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, 'বিডিও আমাকে ডেকে যাঁদের বাড়ির ক্ষতি হয়েচে তার তালিকা চেয়েছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে আমার পক্ষে দেকা সম্ভব হয়নি। তাই আমি আমার পরিবারের সদস্যদের নাম ও অ্যাকাউন্ট নম্বর তালিকায়া লিখে জান দিয়ে দিয়েছি।' পাঁচার বিডিও এষা ঘোষ অভিযোগ সম্পর্কে জানিয়েছেন, 'বিডিও অফিস ত্রাণ কারা পাবেন তা স্থির করেনি। তাই কোনও মন্তব্য করব না।'
আরও পড়ুন: ‘টাকা ফেরান’, আমফান ত্রাণ দুর্নীতিতে এক রব তৃণমূল-বিজেপির অন্দরে
স্থানীয় পঞ্চায়েতের ফরওয়ার্ডব্লক সদস্য ফরিদ মোল্লার কথায়, 'তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যরা বাড়িতে বসেই ওই তালিকা তৈরি করেছে। বিডিও সেটাই মেনে নিয়েছেন। কখন কী হল, কমিটি কখন এলাকায় এল কিছুই জানানো হল না।' এই ধরনের বিষয়ই গ্রামের পর গ্রামের জুড়ে হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে।
দায় এড়াতে অনেক তৃণমূল নেতা, গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বা সদস্যরা 'ষড়যন্ত্রে'র তত্ত্ব খাড়া করছেন। বলা হচ্ছে, চক্রান্ত করে তাঁদের নাম ত্রাণের তালিকায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, প্রশ্ন হল, তাহলে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মিললো কিভাবে।
পাঁচলার রিম্পাদেবীর বাড়ি থেকে ৫ কিমির মধ্যেই বিখিয়াখোলা গ্রামে থাকেন সেলিমা বেগম। তিনিও স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য। তাঁর তিন তলা বাড়িতে ক্ষয়-ক্ষতিপ চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু, সেলিমার ছেলে পেশায় কম্পিউটার শিক্ষক হাবিবুল ত্রাণের টাকা পেয়েছেন। হাবিবুলের কথায়, 'আমি জানি না কীভাবে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা এল। আমাকে ছোট করতেই এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।'
সুন্দরবন, হাওড়া, মেদিনীপুরজুড়ে এই ধরনের দুর্নীতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার বিজেপি শাসিত পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য জিতু সরকারের স্বামী বিদ্যুতের অ্যাকাউন্টেও টাকা ঢুকেছে। পাওয়া, না পাওয়ার এই দৃশ্য চোখে পড়বে ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের দু'ধারেও।
উল্লেখযোগ্য যে, তৃণমূলের পাঁচলা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মুজিবর রহমানই দুর্নীতির অভিয়োগ দায়ের করেছেন। ২২ জুন হাওড়ার জেলা শাসককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানান মুজিবর। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে মুজিবর রহমান বলেন, 'কারা ক্ষমতাধারী ও কীভাবে টাকা পেল তার সবটা প্রকাশ্যে বলা যাবে না। জেলা শাসককে জানিয়েছি। গ্রামবাসীরাও সব জানেন। প্রশাসনকে জানিয়েছি, দলকে সজাগ করে কর্তৃব্য পালন করেছি।'
নামখানা বিডিও অফিসে গিয়ে দেখা গেল, পাঁচজন স্থানীয় যুবক অস্থায়ী ভিত্তিতে যাঁরা ত্রাম পাননি তাঁদের নাম নথিভুক্ত করছেন। বর্তমানে এই যুবকরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবেদন খতিয়ে দেখছেন। বিডিও অফিসের এক কর্মীর কথায়, 'যে টাকা অন্যের অ্যাকাউন্টে পড়ে গিয়েছে তা উদ্ধার করা কার্যত মুশকিলের বিষয়। নতুন করে ৮ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। আশা করব এবার আর দুর্নীতির অভিযোগ থাকবে না।'
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন