Advertisment

গা শিউরে ওঠার মতো নানা কাহিনী লুকিয়ে ডাকাতকালীর পুজোয়

কথিত আছে, সাধক রামপ্রসাদকে বলি দেওয়ার জন্য এই মন্দিরেই এনেছিল ডাকাতদল। বকিটা ইতিহাস।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dakat kali puja will celebrtae at Hooghlys Tribenis Basudevpur

ত্রিবেণীর বাসুদেবপুরের ডাকাতকালী। ছবি: উত্তম দত্ত

অমাবস্যার রাতে চারিদিকে জ্বলছে মশাল। সেই মশালের আলোয় কালীমাতার সামনে হচ্ছে ছাগ বলি। পুরনো রীতি-রেওয়াজ মেনে আজও হুগলির ত্রিবেণীর বাসুদেবপুরের ডাতাককালীর পুজো নিজ-গুণে ভিন্ন। শোনা যায়, একটা সময় নাকি এপুজোয় নরবলিও হতো। তবে কালের নিয়মে সেসব পাট চুকেছে বহু আগেই। তবে পুজোর বাকি রীতি-রেওয়াজ আজও অটুট। এপুজোই রঘু ও বিধু ডাকাতের পুজো বলে খ্যাত।

Advertisment

স্থানীয় মহলে জনশ্রুতি, একশো বছর আগে সরস্বতী নদীর কাছের এই অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ঘেরা ছিল। সপ্তগ্রামের বন্দরে জাহাজ ভিড়লে ডাকাতদলের খুব আনন্দ হতো। এই পথ দিয়ে গিয়েই তারা জাহাজের পণ্যসামগ্রী লুঠ করতো। এমনকী মানুষ-খুন তাদের কাছে ছিল জল-ভাতের সমান। যে সাতটি গ্রাম নিয়ে সপ্তগ্রাম এলাকা তৈরি তারই অন্যতম এই বাসুদেবপুর। হুগলি জেলার মগরা থানার অন্তর্গত বাসুদেবপুর গ্রাম।

ছোটবেলায় ডাকাতের গল্প মানেই এতল্লাটে এখন যাঁরা বয়সে প্রবীণ তাঁদের চোখের সামনে ভেসে উঠত রঘু ও বিধু ডাকাতের সব রোমহর্ষক কাহিনী। এরা দিনের বেলায় নাকি জমিদারের বাড়িতে জোগাড়ের কাজ করত। রাত হলে তারাই নাকি ভোল বদলে হয়ে যেত শিহরণ জাগানো ডাকাত। অনেকটা পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক ও কবি রবার্ট লুই স্টিভেনসনের বিখ্যাত নভেল "ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড"-এর মতো।

এলাকায় কথিত আছে, বিধুভূষন ঘোষ ওরফে বিধু এবং তার দাদা রঘু একসময় এতল্লাটে ডাকাতদলের সর্দার ছিল। একবার বিধু নাকি জঙ্গলে থাকতে তাঁর মায়ের ডাক শুনতে পেয়েছিল। বিধু মায়ের ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করে নিজর ঘরে যায়। ঘরে যেতেই সে হতভ্মব হয়ে যায়। সে দেখে তার মা ঘরেই ঘুমোচ্ছে। সেই ছায়ামূর্তিকে পরে নাকি সে আর দেখতে পায়নি। এলাকায় আরও জনশ্রুতি, তারপরেই একদিন রাতে নাকি স্বপ্নে মা কালীকে দেখতে পায় বিধু ডাকাত। জঙ্গলে মায়ের আদলে যে ছায়ামূর্তি সে দেখেছিল সেই মূর্তির আদলেই ওই জায়গায় 'দখিনা মা'র মন্দির গড়ে তোলে বিধু আর তার দাদা রঘু। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে পুকুর।

publive-image
বাসুদেবপুরের ডাকাতকালী। ছবি: উত্তম দত্ত

এলাকাবাসীরা জানান, ডাকাতের দল সেই পুকুরে স্নান করে মাকে পুজো দিয়ে ডাকাতি করতে যেত। আবার ডাকাতি করে এনেও মাকে পুজো দিত। গা শিউরে ওঠার মতো আরও একাধিক তথ্যও দিয়েছেন স্থানীয়রা। ওই সময়ে ওই মন্দিরের সামনে দিয়ে রাতে কেউ গেলেই, তাকে নাকি মায়ের সামনে এনে বলি দেওয়া হতো। তবে সেসব পাট চুকেছে বহু আগেই। শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো এখনও বয়ে নিয়ে চলেছেন এলাকাবাসীরা।

নিষ্ঠাভরে ফি বছর কালীপুজোর আয়োজন হয়। ডাকাতকালীর পুজো রীতিমতো জনপ্রিয়। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত তো বটেই, এই পুজো দেখতে জেলার বাইরে থেকেও অনেকেই যান প্রতি বছর। পুজোর রাতে বলি হিসেবে মায়ের জন্য একটি ছাগল থাকে। এছাড়াও মানত থাকলে একাধিক ছাগও বলি দেওয়া হয়ে থাকে। মন্দিরের বর্তমান সেবাইত সুমন চক্রবর্তী জানান, পূর্বপুরুষদের মুখ থেকে এই পুজো নিয়ে তিনি অনেক গল্প শুনেছেন। তবে নরবলি বন্ধ হওয়ার পিছনেও নাকি একটি কাহিনী আছে।

আরও পড়ুন- সম্প্রীতির ‘স্বপ্নাদেশ’, চার দশক ধরে শ্যামা মায়ের আরাধনায় মুসলিম মহিলা

মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত সুমনবাবু জানান, একবার মধ্যপ্রদেশ থেকে হালিশহরের বাড়িতে ফিরছিলেন প্রখ্যাত সাধক রামপ্রসাদ। পথে রঘু ডাকাতের খপ্পরে পড়ে যান তিনি। তাঁকে গভীর রাতে বলি দেওয়ার উদ্দেশে মায়ের মূর্তির সামনে হাঁড়িকাঠে এনে দাঁড় করানো হয়। তবে রামপ্রসাদ শেষ অনুরোধ হিসেবে একটি গান গাওয়ার অনুমতি চান। সেই অনুমতি মিললে তিনি গেয়ে ওঠেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান…" তিলেক দাঁড়া ওরে শমন বদনভরে মা কে ডাকি, আমার বিপদকালে ব্রম্ভোময়ী , আসেন কিনা আসে দেখি" ….

publive-image
ডাকাতকালীর মন্দির প্রাঙ্গণ। ছবি: উত্তম দত্ত

শোনা যায় এই গানটি গেয়ে ওঠার সময় ডাকাতের দল রামপ্রসাদের মধ্যে মা কালীর প্রতিচ্ছবি প্রত্যক্ষ করে। অভিভূত হয়ে ডাকাতেরা তাঁকে মুক্তি দিয়ে সসম্মানে পরের দিন হালিশহরে পৌঁছে দিয়ে আসে। এরপর থেকেই সেখানে নরবলি বন্ধ হয়ে যায়। এই মায়ের ভোগ হিসেবে পাশের পুকুর থেকে ল্যাটামাছ ধরে পুড়িয়ে তার প্রসাদ দেওয়া হয় বিশেষ দিনে। এখানে মায়ের মন্দির গম্বুজাকার এবং এক চূড়া বিশিষ্ট।

মা কালী এখানে রুদ্রমূর্তিধারিনী। তাঁর চার হাত। বাঁদিকের দুই হাতে আছে তলোয়ার এবং কাটা মুণ্ড। সুমনবাবু আরও জানান, মূলত ডাকাত কালীর প্রতীক হিসেবে ওই তলোয়ার মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ৫ বিঘা জমির ওপরে মায়ের মন্দির। আগে মন্দিরটি বেহাল থাকলেও বর্তমান বিধায়কের হস্তক্ষেপে মন্দিরের পাঁচিল থেকে শুরু করে কংক্রিটের চাতাল সবই হয়েছে। এছাড়াও ভক্তদের দানে মন্দিরের বেশ কিছু উন্নতিও হয়েছে। তবে মূল মন্দিরের ছাদের অবস্থা এখনও ভালো নয়। সংস্কারের এখনও বেশ কিছু কাজ বাকি আছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Hooghly Kalipuja 2021
Advertisment