শহর কলকাতা। গতিময় তার জীবন যাপন, রূপ বদলাচ্ছে প্রতিদিন। আবার এই শহরই বুকে আগলে রাখে তার ঐতিহ্য। যা বিশেষ সময়ে শুধু সামনে আসে। দুর্গাপুজোর সময়টা তেমনই মাহেন্দ্রক্ষণ। ইউনেস্কো কলকাতা শহরের সেই ঐতিহ্যকেই সম্মান দিয়েছে। যার অংশীদার ২১৭ বছরের এক পুজোও। কলকাতা যাকে দর্জিপাড়ার মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজো নামে চেনে।
এই বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল রাধাকৃষ্ণ মিত্রের হাত ধরে। বিখ্যাত ব্যবসায়ী রামদুলাল দে সরকারের বড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রাধাকৃষ্ণর। তাঁর পরবর্তীতে পুজোর দায়িত্বভার তুলে নেন মেজ ছেলে রাজকৃষ্ণ। সেখান থেকে অমরেন্দ্রকৃষ্ণ, মানবেন্দ্রকৃষ্ণ হয়ে এখন এই বাড়ির পুজোর দায়িত্বে অনুসূয়া মিত্র বিশ্বাস ও পরিবারের অন্য মেয়েরা। ঠাকুরদালানের খিলান, স্তম্ভ, বাতি আজও সাক্ষী দিচ্ছে সেই ঐতিহ্য, পরম্পরা, পুজোর হাতবদলের।
ঐতিহ্যবাহী এই পুজো কোনও শরিকি ব্যবস্থা বা ট্রাস্টের মাধ্যমে হয় না। পরিবারের নির্দিষ্ট সদস্যরাই সারাবছর অর্থ সঞ্চয় করে বাকিদের সহযোগিতায় পুজোর দায়িত্ব পালন করেন। যেমন, মানবেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্রের তিন ছেলের কারও কোনও পুত্রসন্তান না-থাকায় বাড়ির মেয়েরাই এখন পুজো পরিচালনা করছেন। সেই হিসেবে এই পুজো বর্তমানে মহিলা পরিচালিত। যেন, ঐতিহ্যের মধ্যেও যুগের ছাপ।
রথের দিন হয় কাঠামো পুজো। দুর্গামূর্তি তৈরি হয় বাড়িতেই। পুরনো ছাঁচেই গড়া হয় নতুন প্রতিমা। অন্যান্য বৈষ্ণব মতে হওয়া পুজোর রীতি মেনে এখানে দেবীর বাহন অশ্বরূপী সিংহ। কুমোরটুলি থেকে আসে ডাকের সাজ। বাড়ির ছোট-বড় সকলে মিলে, দেবী প্রতিমাকে সাজিয়ে তোলেন। প্রতিপদ থেকে শুরু হয় বোধনের রীতি পালন।
বৈষ্ণব মত মেনে কোনও পাঁঠাবলি এখানে হয় না। পাঁঠার পরিবর্তে দেবীকে দেওয়া হয় চিনির নৈবেদ্য। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত, তিন দিনই হয় কুমারী পুজো। অষ্টমীর দিন বাড়ির সদস্যদের নাম ধরে চিনির নৈবেদ্য দেবীর কাছে নিবেদন করা হয়। অষ্টমীতে সন্ধি পুজোর সঙ্গে কল্যাণী পুজোও হয়। এখানে ১০৮টি পদ্মের জায়গায় ১০৮টি অপরাজিতা ফুল ব্যবহারের রীতি রয়েছে। নবমীতে হোম ও প্রদক্ষিণের মাধ্যমে হয় দেবীর আরাধনা।
দশমীতে কনকাঞ্জলির পরে মা দুর্গার সামনে বাড়ির মহিলারা বসেন। প্রার্থনা করেন, মা দুর্গার মাতৃস্নেহ ও অপরাজিত শক্তির আধার যেন তাঁদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। বাড়ির মহিলারা মাছ-ভাত খেয়ে, মুখে পান নিয়ে দেবীকে বরণ করেন। এই পান সাজানোর মধ্যেও রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্যের বিশেষ ছাপ।
ঠাকুর বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় বাড়ির ছেলেরা কাঁধে চাপিয়ে হেঁটে নিয়ে যাবেন, সেটাই এবাড়ির পুজোর বৈশিষ্ট্য। ছেলেদের পরনে থাকে ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে পুরোনো দিনের কায়দায়- ছড়ি। আগে বাড়ির ছেলেরা খালি পায়ে হেঁটে যেতেন। এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার সময় পায়ে থাকে চপ্পল। বিসর্জনের সময় নীলকণ্ঠ পাখিও একসময় এই পুজোয় ওড়ানো হত। এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সময় এভাবেই ছাপ ফেলছে প্রতিটি পদে। তবুও পুজো আসলেই, এই বাড়ির সদস্যরা যেন চলে যান প্রায় ৩০০ বছর আগের এক ইতিহাসে। যে ইতিহাস দুর্গাচরণ মিত্রের ভাইয়ের ছেলে নীলমণি মিত্রের। ইংরেজ সরকারের আরবিট্রেটর ছিলেন নীলমণি। কোম্পানি বাহাদুর একবার তাঁর ঘনিষ্ঠদের সমস্যা নিষ্পত্তির ভার দিয়েছিল নীলমণির ওপর। নারাজ নীলমণি হাজারো অনুরোধেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিকারিকদের বোঝাতে পারেননি, যে তিনি ওই নিষ্পত্তির দায়িত্ব নিতে পারবেন না।
আরও পড়ুন- পুজোর আকাশ আরও রঙিন করলেন মুখ্যমন্ত্রী! লাখ-লাখ বঙ্গবাসীর ঋণ মকুবের ঘোষণা
বাধ্য হয়ে তিনি সম্পত্তি ছেড়ে সপরিবারে হয়েছিলেন কাশীবাসী। সেখানেই মৃত্যু হয়েছিল নীলমণির। মারা গিয়েছিলেন তাঁর ছেলেও। সেই সময়ই নীলমণি মিত্রের বিধবা পুত্রবধূ সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন দর্জিপাড়ায়। সেই সন্তানদেরই অন্যতম রাধাকৃষ্ণ। বাড়ির ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর প্রতিষ্ঠাতা। তারও আগে অবশ্য রাধাকৃষ্ণের বড় ভাই প্রাণকৃষ্ণ নিজে হাতে গড়ে তুলেছিলেন কালীমূর্তি। শুরু করেছিলেন বাড়ির কালীপুজো। যা আজ ২৩১ বছর ধরে মিত্র পরিবারের অন্যতম ঐতিহ্য হয়ে রয়েছে।