বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই, তবে শরীরে অদম্য ইচ্ছে। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর, অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার - নতুন মানুষদের সঙ্গেও আলাপ করতে বেজায় ভালবাসেন তিনি। রেকর্ডের তালিকাও বেজায় কম নয়। উদয়নারায়ণপুরের বাসিন্দা, তাঁর নাম ঠাকুরদাস শাসমল - সকলের কাছে পরিচিত দাশুদা নামেই। নয় সাইকেল নয় মোটরবাইক, সঙ্গে নিতে ভোলেন না ভারতের জাতীয় পতাকা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফ থেকেই যোগাযোগ করা হয় তাঁর সঙ্গে। তাঁর সাহস এবং ইচ্ছেকে কুর্নিশ। নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিলেন তিনি।
হঠাৎ করে ঘোরার ইচ্ছে? নাকি সুপ্ত বাসনা অনেকদিনের ছিল?
দাশু দা: ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না একেবারেই। চাষবাস করে খাই, এত টাকাপয়সা কোথা থেকেই বা পেতাম! গুনে গুনে ৮ কাঠা জমিও নেই, কতই বা অর্থ আসে সেই থেকে। তবে মনে ইচ্ছে ছিল প্রচুর। চাষের কাজ করেও পরবর্তী যে সময় পাওয়া যায় সেই সময়েই একলা হোক কিংবা দলবলে বেড়িয়ে পড়ি।
এতে অনেক আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হয়- কীভাবে সবকিছু ম্যানেজ করেন?
দাশু দা: ভিলেজ বাইকার্স নামের একটি ক্লাব আছে আমাদের। সেইখানে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও রয়েছেন। আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়, তাদের মধ্যেই কেউ পুলিশ কেউ শিক্ষক। তারাই সবরকম ব্যবস্থা করেন। এই ক্লাব যখন তৈরি হয়, ২০০৩ সালে তারপর থেকে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন কিন্তু কেউই সময় দিতে পারে না। অগত্যা আমাকেই এগিয়ে আসতে হয়, সকলেই পাশে আছেন তাঁদের উৎসাহ আর সাহায্য নিয়েই এগিয়ে চলা। আর এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে অনেক আর্থিক অনুদান আসে। সব মিলিয়ে সুযোগ বুঝেই বেড়িয়ে পড়া।
এত রাজ্যে যান, কেমন সাপোর্ট পান অন্যান্য জায়গায়?
দাশু দা: এখন গ্রুপ বেড়ে গিয়ে সারা ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। কোনও জায়গায় পৌঁছে প্রথম কথা আপ্যায়নের ত্রুটি নেই, আর যদিও বা সমস্যা হয় তবে সারা দেশজুড়ে আমাদের গ্রুপের মানুষ জন ছড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সবসময় তারা তৎপর।
কীভাবে শুরু এই যাত্রা?
দাশু দা: ১৯৯৪ সাল থেকে ঘুরতে যাচ্ছি। তখন এত রাস্তাঘাটে কড়াকড়ি ছিল না। পুলিশও বেশি তৎপর ছিল না। প্রথম যাই পুরী। ১৯৯৮ সালে আরেক ভাইকে নিয়ে দার্জিলিং যাই, তবে বাড়ি থেকে মিথ্যে বলেই। মুর্শিদাবাদ যাব এই বলে বেড়িয়ে পড়ি। পাহাড়ি রাস্তায় তখন যেতে গেলেই অনেকে মানা করতেন কিনা। সেই যে নেশা লাগল, এখনও ঘুরছি।
পরিবারে কে কে আছেন? তাঁরা কীভাবে সাপোর্ট করেন?
দাশু দা: ( হেসে ) আমার স্ত্রী বলেন, আমি গোটা পরিবারকে জ্বালাচ্ছি। বাড়ির লোক তো চিন্তা একটু করবেই। প্রথম প্রথম একেবারেই কেউ মন থেকে রাজি হত না। তবে এখন সম্পূর্ণ সাপোর্ট রয়েছে। এখন আমার ঘুরতে যাওয়ায় তারাও উৎসাহ দেন। বাড়িতে আমরা কর্তা গিন্নি, আর এক ছেলে দুই মেয়ে তাঁদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে, এখন এক্কেবারে ঝাড়া হাত পা। বাচ্চা ছেলেদের মত ঘুরে বেড়াবো এটাই প্ল্যান।
ভারতের মধ্যে সবথেকে কোন জায়গা ভাল লেগেছে আপনার? কিংবা আবারও ইচ্ছে আছে যাওয়ার?
দাশু দা: আমার এবং আমার ভাইয়ের গোটা দেশ সম্পূর্ণ। অল ইন্ডিয়া ঘুরে আসার পর নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। আগে মোটরসাইকেলে ঘুরে এত বুঝতে পারিনি। তবে ২০১৮-তে সাইকেল নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। উদ্যোগ ছিল গোল্ডেন স্কোয়ার - কলকাতা-দিল্লি-মুম্বই-চেন্নাই-কলকাতা এই সফর নামায় একাই ছিলাম। ৫৯ দিনের মধ্যে ১৪টি রাজ্যে এত ভালবাসা পেয়েছি বলে বোঝানো যাবে না। একদিন শুধু তাঁবুতে ছিলাম, বাকিদিন সেখানকার মানুষদের সহযোগিতায় ভাল হোটেলে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁরা আমার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলেছে, অনেক সাহায্য করেছিল।
বিদেশ ভ্রমণ হয়েছে? সেই নিয়ে কী প্ল্যান?
দাশু দা: প্রতিবেশী দেশগুলো হয়েছে। নেপাল ভুটান গেছিলাম। মোটরসাইকেলে গেছিলাম। নেপালের সৌন্দর্য ভূমিকম্পের পর অনেক বদলে গেছিল। কম করে পাঁচবার গেছি নেপাল। পুরনো দিনে, তখন শহর থেকে পশুপতিনাথ আর শম্ভুনাথ মন্দিরের দৃশ্যই ছিল অসাধারণ। তবে পরে অনেক রাস্তা বদলে গেছে, চেনা দায়। কোভিড না থাকলে বিদেশের ২৮টা দেশ এতদিনে হয়ে যেত।
লাদাখের গল্প একটু বলুন?
দাশু দা: ( হেসে ) সে এক দারুণ গল্প। ২০২১ সালে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে ছিলাম ৫ জন। ঠিক যখন লেহ থেকে ১০০/১৫০ কিমি পেছনে ফতু-লা পাসের কাছে, সেই সময় একজনের ভুলবশত হাত ভেঙে যায়। ওখানে যাওয়ার আগেই কার্গিল পৌঁছে এক অসাধারণ অনুভূতি। লক্ষণপুর সীমান্তেও অনেক ভাল সময় কাটিয়েছি, সেনা বাহিনীর অনেকেই এখন আমায় চেনেন। এই নিয়ে তিনবার গেলাম, খুবই ভাল লাগল।
পরবর্তী দিনে কোথায় যাবার চিন্তা রয়েছে?
দাশু দা: যদি বাইরের দেশে না যাওয়া হয়, তাহলে ফতুলা পাস থেকে খারদুং-লা, চাং - লা পাস হয়ে শ্রীনগর আসার ইচ্ছে। সেখান থেকেই একজনকে সাইকেলে চাপিয়ে ডবল ক্যারি করেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী যাওয়ার প্ল্যান রয়েছে। যেটা কেউ করেনি, সেটা আমি করে দেখাতে চাই।
সঙ্গে থাকে তাঁবু আর রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা, এইভাবেই নিজের উদ্যমে এগিয়ে চলেছেন উদয়নারায়ণপুরের ঠাকুরদাস বাবু।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন