Pride Love Story: গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হল দু'জন! প্রাইড মান্থে দেবাংশী আর শানের স্বপ্নপূরণের গল্প

Pride Month Special: এই মাস শুধু রঙিন উৎসবের নয়, বর্ষার ফোঁটার মতোই হাজারো না-পাওয়ার দগদগে ক্ষত ধুয়ে-মুছে এক নতুন শুরুর মাস। বৃষ্টি ভেজা সবুজ পাতায় জমে থাকা জল। ছোট ছোট স্বপ্নগুলো নতুন কুঁড়ির মতন ফোটে ।

Pride Month Special: এই মাস শুধু রঙিন উৎসবের নয়, বর্ষার ফোঁটার মতোই হাজারো না-পাওয়ার দগদগে ক্ষত ধুয়ে-মুছে এক নতুন শুরুর মাস। বৃষ্টি ভেজা সবুজ পাতায় জমে থাকা জল। ছোট ছোট স্বপ্নগুলো নতুন কুঁড়ির মতন ফোটে ।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
COver Photo (1)

নতুন নতুন সুখের সংসার, গল্প বললেন সুখী দম্পতি... Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)

Debangshi Shaan Pride Love Story: সব প্রেমের গল্প একরকম নয়। কিছু প্রেম থাকে নিরিবিলি, শান্ত নদীর মতো, বয়ে চলে, শব্দ করে না। আবার কিছু প্রেম ঝড়ের মতো, সমাজের দেয়াল ভেঙে, বাঁধা ভেঙে, মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। দেবাংশী আর শানের প্রেম তেমনই। প্রাইড মান্থের রঙিন ছাতার নিচে এক সাহসী স্বপ্নের নাম।

Advertisment

এই মাস শুধু রঙিন উৎসবের নয়, বর্ষার ফোঁটার মতোই হাজারো না-পাওয়ার দগদগে ক্ষত ধুয়ে-মুছে এক নতুন শুরুর মাস। বৃষ্টি ভেজা সবুজ পাতায় জমে থাকা জল। ছোট ছোট স্বপ্নগুলো নতুন কুঁড়ির মতন ফোটে । বৃষ্টিভেজা হালকা শিরশিরানি হওয়া, গায়ে এসে লাগে। হালকা বৃষ্টির ছাট যেন মনে করিয়ে দেয়, এই পৃথিবী সুন্দর। সুন্দর যেমন মেঘের ফাঁকে সূর্যের আলোয় ওঠা রামধনু। আত্মবিশ্বাসে ভর করে যেন শত যুদ্ধও জেতা যায়। কোনো বেহিসাবি অযৌক্তিক দেওয়াল চিরকাল থাকে না ভেঙে ফেলা যায় সব ঠুনকো মানসিকতা।

উত্তরপাড়ার মানুষ শান। তাঁর ছোট থেকেই ফুটবল খেলার শখ। শরীর গঠন মেয়েদের হলেও মন তো পুরুষ। তুতো দাদা ছিল রোল মডেল। হাঁটা চলা আদব কায়দা সবই হতে হবে দাদার মতন। মেয়ে হয়ে ছেলেদের মতন চাল চলন! বাড়ির লোকে মানবে কেন! পাড়ার বন্ধু বান্ধব সব বন্ধ হল। চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী হল ইচ্ছেরা। উল্টোদিকে দেবাংশী। ছোট থেকে মায়ের আলমারিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা শাড়িগুলোর দিকেই আকর্ষণ ছিল তাঁর। শরীর পুরুষের। মনে মধ্যে লুকিয়ে আছে এক নারী। যে সাঁজতে চায়। রঙিন শাড়ি পড়ে স্কুলের সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিতে চায়। এসব সমাজ মানবে কেন! জুটল মারধর। কটু কথা। অশ্লীল ইঙ্গিত। একজন নব্বইয়ের দশকের আরেকজন বিশের দশক। জেদ আর অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইয়ে দুজনের গল্পটা যেন এক সূত্রে বাঁধা পড়ে যায়।

(এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
Advertisment

এতসবের পরেও ওদের দমিয়ে রাখা যায়নি। ওরা লড়াই করেছে। বাঁচার। ঈশ্বর প্রদত্ত খোলস ছেড়ে ওরা বেরিয়ে এসে, নিজেরা তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের পরিচয়।

জুন মাস প্রাইড মান্থ। এলজিবিটিকিউ+ কমিউনিটির কাছে এই মাস শুধুই উৎসব নয়, বুকের ভেতর জমে থাকা পরিচয়, ভালোবাসা আর অধিকারকে আলোর নিচে নিয়ে আসার মাস। এই মাস বলে, ভালোবাসা লুকিয়ে থাকবে না, ভালোবাসা বুক চিতিয়ে বলবে, “আমি আছি, আমি থাকব, ঠিক যেমন আছি।” বাঁচার অধিকার সবার।

ঠিক এমনই প্রাইড মান্থ অর্থাৎ জুন মাসের মাঝামাঝি, সব লড়াই, সব চোখরাঙানি আর সমাজের বাঁধা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের নতুন ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে দেবাংশী বিশ্বাস চৌধুরী আর শান চৌধুরী। এক যুগল, দুই রূপান্তরকামী মানুষ, আর এক অটল ভালোবাসা, যা শেষ পর্যন্ত পেল আইনি স্বীকৃতি। গুটিপোকা থেকে ডানা মেলে প্রজাপতি হল দু'জন। ওরা প্রমাণ করল। ভালোবাসা বুকের গভীরে জমে থাকা এক ফোঁটা সাহসের নাম।

বিয়ের দিন শান-দেবাংশী 

শুরুটা হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৮শে জুন। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনের এক ছোট্ট ডকুমেন্টেশন ওয়ার্কশপে প্রথম দেখা দেবাংশী আর শানের। বাইরে তখন বৃষ্টি, ভিজে গাছের ডালে জমে থাকা জলের ফোঁটার মতোই দুজনের বুকের ভেতর লুকিয়ে ছিল না বলা হাজার গল্প। সেই গল্পগুলো এক অদৃশ্য সুতোর টানে মিশে গেল একে অপরের মধ্যে। গল্পের শুরু।

সেই অচেনা দুপুরটা কীভাবে যে ওদের জীবনের সংজ্ঞা বদলে দিল, কেউই বলতে পারবে না। বন্ধুত্বের এক ধাপ এগিয়ে ওরা একে অপরের বুকের ভেতর হারিয়ে গেল। বৃষ্টি ভেজা অলস দুপুরে ভালবাসার গল্পের পাতা উল্টাতে গিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল দেবাংশী। সামলে নিচ্ছিল শান। ২০২৩ সালের পর থেকে শানই তো সামলে এসছে! আগোছালো শান্ত স্বভাবের মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেলছে দেবাংশী। দুজনেই কথাতেই একই সুর, পাশাপশি বসে থাকা, প্রেম ভালবাসা, এই পথ এতটাও মসৃণ ছিল না। যেন চারপাশে কাঁচের স্বচ্ছ দেওয়াল, গলার কাছে কাঁটা, সমাজের হাজারটা অবিশ্বাস আর বাঁকা কথা। এটাই ছিল তাঁদের প্রতিদিনের সঙ্গী।

“ট্রান্স ছেলে-মেয়ের সম্পর্ক? এটা কি টিকবে?”
“ভবিষ্যৎ কী আছে?”
“সমাজ মানবে?”

প্রতিটি প্রশ্নই ছিল ছুরি, কিন্তু ভালোবাসা কাগজে-কলমে সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। দেবাংশী আর শান দুজনেই জানতেন। তাদের লড়াই অন্যরকম, তাদের স্বপ্নের দামও অনেক বেশি। সমাজের চাওয়া-পাওয়া, বোঝাপড়া, না বোঝার ব্যথা সব পেরিয়ে ওরা হাতে হাত রেখেছে। কখনও উত্তরপাড়ার গলিতে, কখনও কফি হাউসের কোনে, কখনও বিজয়ার কোলাহলে পরিবারের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে।

প্রাইড মান্থের এই আলো আর রঙের মধ্যে, লড়াই আর গর্বের গল্পের ভিতরেই ওরা খুঁজে পেয়েছে নিজেদের জন্য এক নতুন সূর্যোদয়। ১৫ই জুন ২০২৫, ওদের স্বপ্নে চিরকাল যে স্বীকৃতির অভাব ছিল, সেই শূন্যতা মুছে দিল আইনি বিয়ে। এই বিয়ে কেবল দুজন মানুষের নয়। এ এক লড়াইয়ের জয়, যে জয় বলে দেয়। ভালোবাসা আসলে যতবার ভাঙা যায়, ততবারই সে জোড়া লাগে, আবার বাঁচে।

 ভরসার হাত - (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)

ওদের দুজনের কথায়, “ভালোবাসা মানে শুধু একে অপরকে জড়িয়ে ধরা নয়, ভালোবাসা মানে একে অপরের জন্য লড়ে যাওয়া। মা-বাবাকে বোঝানো, পরিবারকে বোঝানো, সমাজকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া, কেন আমাদের ভালোবাসা কম হবে?’’

এখনও দেশে সমলিঙ্গ বিয়ে বা ট্রান্স দম্পতির আইনি বিয়ে একেবারেই সহজ নয়। অনেক জায়গায় আলাদা নথিপত্র, সরকারি অফিসে হাজারো প্রশ্ন, সমাজের মানসিকতা। সবই একসাথে লড়াইয়ের অংশ।

তবুও লড়াই থামছে না। মুম্বাই, কলকাতা, ব্যাঙ্গালোরের মতো শহরে প্রাইড প্যারেডে লাখো মানুষ বের হন, নতুন প্রজন্ম আরও সরব, সোশ্যাল মিডিয়ায় দিন দিন বাড়ছে সচেতনতা। অনেকেই চুপিচুপি বলছেন, ‘‘হয়তো এবার সময় এসেছে আরেকটু খোলামেলা ভাবে নিজের পরিচয় নিয়ে বাঁচার।’’

দেবাংশী আর শানের এই ছোট্ট গল্প সেই বড় লড়াইয়েরই এক নতুন রসদ জোগাচ্ছে। বেঁচে থাকার। ওদের এই স্বীকৃতি আর সাহস হয়তো একদিন আরেকজনকে ভরসা দেবে ভারতের বড় বড় শহরে এখন প্রাইড মান্থ ঘিরে নানা কর্মসূচি চলে। আলোর সাজ, রঙিন মিছিল, প্যানেল আলোচনা, লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি। এরই ফাঁকে দেবাংশী আর শানের এমন ব্যক্তিগত গল্পগুলো নতুন আলো দেখায়। দেওয়াল পেরিয়ে একটু আলোর খোঁজ, একটু নিজের মতো বাঁচার অধিকার।

Couples LGBTQ news of west bengal