Advertisment

পুরনো দিনের নাটক, সিনেমার হারিয়ে যাওয়া গান এবং সুর খুঁজে পাওয়া যাবে হাওড়াতে

শুধুমাত্র রেকর্ড কিংবা গান সংগ্রহই নয়, 'অবাক সংগ্রহশালায়' মিলবে বাংলার দুষ্প্রাপ্য সব নথিও।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
Debjit Banerjee's collection contains many artifacts of the ancient culture of undivided Bengal

নিজের অবাক করা বেশ কিছু সংগ্রহের মাঝে দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

ধর্মতলা স্ট্রিটের ট্রামলাইন ধরে টিপু সুলতান মসজিদকে বাঁ পাশে রেখে ওয়েলিংটন মোড়ের দিকে এগোলে ফুটপাথের আশেপাশে চোখে পড়বে কিছু পুরনো রেকর্ডের দোকান। যানবাহনের কর্কশ আর্তনাদ উপেক্ষা করে মাঝে মাঝেই ভেসে আসে চেনা-অচেনা বহু গানের সুর। এই সব দোকানে দেখা মেলে সারি সারি লং প্লেয়িং রেকর্ড আর পিতলের চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনের। আর মাটিতে এদিক সেদিক করে রাখা থাকে গ্রামোফোন রেকর্ড। ধুলোমাখা রেকর্ডের স্তূপেই এক সময় মিলত গহরজান, মৈজুদ্দিন, মালকাজান অথবা গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর ডিস্ক। এখনকার প্রজন্মের অনেকেই হয়তো এদের গান শোনা তো দূরে থাক, নামগুলোও হয়তো শোনেননি। সময় বদলেছে। বদলেছে শিল্পীদের গানও। যেটা বদলায়নি সেটা মানুষের গান শোনার অভ্যাস।

Advertisment

পুরনো দিনের শিল্পীদের গান সেভাবে সংরক্ষণ করে নেই। তার জন্যেই হয়তো বর্তমান প্রজন্মের কাছে অতীতের শিল্পীদের সঙ্গে তেমন পরিচয় ঘটেনি। পুরনো দিনের সেসব গানই সংরক্ষণ করে রাখতে ভালবাসেন দেবজিৎ। পুরো নাম দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়স ৬৮'র কাছাকাছি। দেবজিৎ বাবু নিজেও একজন শিল্পী, সঙ্গীতকার। তবে শুধু সেখানেই থেমে থাকে না তাঁর পরিচয়। তিনি এই শহরের একজন অন্যতম গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক। দীর্ঘ বহু বছর ধরে গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে আসছেন তিনি। বাড়িতেই তৈরি করেছেন বিশাল এক সংগ্রহের ভাণ্ডার। যা দেখে রীতিমত তাজ্জব হয়ে যেতে হয়, বিস্ময় নিয়ে তাকাতে হয় একটা লোকের নিষ্ঠা, ভালোবাসা ও অধ্যবসায়ের দিকে। শুধুমাত্র রেকর্ড কিংবা গান সংগ্রহ নয় দেবজিৎবাবুর ঝুলিতে রয়েছে বাংলার দুষ্প্রাপ্য সব নথিও। পুরনো ইতিহাস, অবিভক্ত বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির অজানা সব জিনিস। এমন সব পুঁথির ভগ্নাংশ যা থেকে উঠে আসতে পারে অজানা ইতিহাসের সব তথ্য। এসবই তিনি রেখেছেন এক ছাদের তলায়। নাম 'ইন্দিরা সংগ্রহশালা'।

আরও পড়ুন- ব্রিটিশ জমানা থেকে আদি কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ নথি-নিদর্শন, সবই আছে এই বাঙালির সংগ্রহে…

publive-image
সোনালী সংগ্রহের মাঝে দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাওড়ার এমন অভাবনীয় সংগ্রহশালা দেখে রীতিমতো অবাক হতে হয়। সংগ্রহশালা অ্যাকাডেমি অফ আর্কাইভ ঘুরে দেখাতে গিয়ে দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, 'ছোটবেলা থেকেই সংগ্রহের নেশা। বয়স তখন চার, পাঁচ হবে! তখন সংগ্রহের বিভিন্ন দিক ছিল এখন সংগ্রহের সংজ্ঞা বদলেছে। আমি প্রথম দিকে খেলনা গাড়ি সংগ্রহ করতাম। এরপর বড় হয়ে বই সংগ্রহ শুরু করি। তারপর ধীরে ধীরে গান, রেকর্ড এসব সংগ্রহ করতে শুরু করি। কলেজে পড়াকালীন অনেক বই আমি অনেককে দিয়ে ফেলি। সেসব বই কতটা অমূল্য ছিল এখন তা বুঝতে পারি। যাইহোক বর্তমানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থেকে লোলোব্রিজিডার সই করা বই। এর পাশাপাশি হাজার বিশেক গ্রামোফোন রেকর্ড। পালা নাটক। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, প্রভাদেবীর অভিনয় আর গান। উৎপল দত্ত থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিঠি। সব কিছুই আমার কাছে রয়েছে। এই সংগ্রহশালাটির নাম রেখেছি ইন্দিরা গ্যালারি। এটি আমার মায়ের নামে। পাশাপাশি আরেকটি ঘর রয়েছে অজিত আলয়। এটি বাবার নামে। 'ইন্দিরা' গ্যালারিতে চলবে থিয়েটার, গান, সিনেমা নিয়ে প্রদর্শনী। 'অজিত আলয়' কক্ষে চলবে মহলা। এখানে বসে যে কেউ রিহার্সাল, গবেষণা এসবের কাজ করতে পারেন'।

আরও পড়ুন- কলকাতার এই প্রবীণ সংগ্রহ করেন উনিশ শতকের অমূল্য সব ‘সুচ-সুতোর’ ভালোবাসা

publive-image
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

উনিশ শতকের কলোনিয়াল কলকাতা জুড়ে ছিল নবাব-জমিদার-রাজা-রইসদের বাবুগিরির বিনোদ-বিলাস। তাঁদের সাহচর্যে বাই-বারাঙ্গনা নটী-বিবিদের রকমফের চরিত্রগাথায় নাট্যকারভেদে মুখর হয়েছে বহুবিচিত্র থিয়েটারের গান বা মঞ্চগান। উনিশ থেকে বিশ শতক মঞ্চগানেই প্রকাশ পেয়েছে কলকাতা তথা বাংলার বাবুজীবনের ছবি। এসব গান মোটামুটি খাতায় কলমে তুলে নিজের কণ্ঠে তুলে রেখেছেন দেবজিৎ। কয়েক দশক ধরে তিল তিল করে সংগ্রহ করা এসব জিনিস নিয়ে কথা বলতে বলতে নিজেই সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন।

publive-image
বহু পুরনো কিছু বাদ্যযন্ত্রও রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

খোদ কলকাতায় অ্যাকাডেমি থিয়েটারের উদ্যোগে ভারতে প্রথম কম্পোজিট আর্কাইভ। এমন সুন্দর আর্কাইভ অন্য কোথাও আছে কিনা বলা খুব মুশকিল। "সিনেমা, নাটক নিয়ে কাজ হয়েছে। কিন্তু এসবের পিছনের গল্প? থিয়েটারের গান থেকে যে চালু হল, গানের প্রথম রেকর্ডিং, সেটাও তো পরের প্রজন্মের জন্য কোথাও রাখতে হবে? এই ভাবনাগুলো থেকেই আর্কাইভ তৈরি করেছি, এই সংগ্রহশালা" বলছিলেন দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। সিনেমার পোস্টার, বুকলেট, লবিকার্ড-ও আছে একেবারে শুরুর সময় থেকে। সময়কে ধরে রাখবে মুদ্রা বা কারেন্সি নোটের বৈচিত্র্য। সার্বিক শিল্পচর্চার আশায় অ্যাকাডেমি থিয়েটারে থাকছে আরও গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের দলিল। 'বীণাবাদিনী', 'দিগদর্শন' এর সঙ্গে বিদেশি 'ইরস'-এর প্রথম সংখ্যা। রবীন্দ্রনাথ থেকে রবিশঙ্কর, ব্রেখটের গান। ভাবা যায়!

আরও পড়ুন- আদি থেকে আধুনিক, কলকাতার ‘ক্যামেরাম্যান’-এর জিম্মায় এক স্বর্ণালী ‘ইতিহাস’

publive-image
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

ব্রেখটের নিজের গলায় গাওয়া গান ওস্তাদ সাগিরুদ্দিন খানের ব্যবহার করা সারেঙ্গী! এসব দেখে ঘোড় লেগে আসে। পুরনো সময় যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। বিখ্যাত সরোদিয়া কেরামতুল্লা খানের কথা শুনেছি আমরা। কিন্তু তাঁর সরোদ যে নিজের চোখে দেখার সুযোগ এই সংগ্রাহকের কাছে না এলে হয়তো পাওয়া যেত না। কলকাতার বুকে এমন সংগ্রহশালা তৈরি করা চাট্টিখানি ব্যাপার না। তা প্রথম দেখাতেই বোঝা যায়।

এই সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে যে অর্থের প্রয়োজন তা সব জোগাড় করেছেন নিজেই। কলকাতা শহরে এমন একটি সংগ্রহশালা তৈরি পরিকল্পনা করার কথা বলেও কারো কাছে কোন সুফল পায়নি। মেলেনি কোনও সরকারি সাহায্য। 'আমি এখানে ওখানে অনেক ঘুরেছি, কিন্তু কোনও সরকারি অর্থ সাহায্য এখনও পাইনি।' হয়তো এই ক্ষোভই তাঁর নিজের ইচ্ছেকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৮২১ সালের শেক্সপিয়র থেকে মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার প্রথম সংস্করণ সব ছুয়ে দেখা যায়। আর্কাইভের দেওয়ালে ঝুলছে নায়ক সিনেমার উত্তম কুমারের হাতে সিগারেট ধরা সেই বিখ্যাত ছবি।

আরও পড়ুন- সংগ্রহ নয়, ওনার ঘরদোর জুড়ে শুধু ‘কালি এবং কলমে’র প্রেম

publive-image
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

এছাড়াও ঋত্বিক, সত্যজিৎ আরও অসংখ্য বাংলা ছবির পোস্টার। ঘরের এক কোনায় থাকা রেকর্ডের আলমারি। সংখ্যায় প্রায় দশ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। আশপাশ ঘুরে দেখাতে গিয়েই দেবজিৎ বাবু দেখালেন বিনোদিনীর সঙ্গী বনবিহারিনীর গানের পিচবোর্ডের রেকর্ড। সেই রেকর্ড এখনও অবিকৃত রয়েছে এই সংগ্রহশালায়! অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি থেকে শিশির ভাদুড়ির অভিনয় সমৃদ্ধ সেই সব রেকর্ডগুলো দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। সব সংগ্রহগুলো খুটিয়ে দেখতে গেলে হয়তো গোটা একটা দিন কম বলে মনে হবে।

অ্যাকাডেমি অফ আর্কাইভ পুরনো সময়দের নিজের বুকে আগলে রেখেছে। এখানের প্রত্যেকটা জিনিস যেন নিজেদের গল্প বলছে। এই সংগ্রহশালা যেন পুরনো দিনের সঙ্গে নতুন যুগের একটা যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছে। আর যোগ সূত্রের যে সুতো বাঁধার কাজটি অক্লান্তভাবে করে যাচ্ছেন বছর আটষট্টির কলকাতার এক শিল্পী সংগ্রাহক।

West Bengal Unique Collection Rare Collection Debjit Banerjee
Advertisment