'কতো নেতা আইলো আর গ্যালো। নদী ভাঙ্গনের হাত থেইকা আমাদের বাঁচাইতে পারলো না। কোনও সরকারী সাহায্য পায়না। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ে আমাগো বাড়িঘর সব উইড়্যা যায়! শহরের কয়েকটা বাবু আসে শুকনা খাবার দেয়। পরিস্থিতি ঠিক হইলে আবার বাড়ি বানায়, বাড়ি ভাঙ্গে! এরকমই চলে বছরের পর বছর। মোগো ভাগ্যেরও কোন পরিবর্তন হইলোনা।'- আক্ষেপ করে কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন আঞ্জুমান বিবি। হোগলা পাতার ঘর খড়ের ছাউনি দেওয়া ছাদ। সাগর পাঁচ নম্বর গ্রামে পর পর পাঁচটি বাড়িই একরকম দেখতে। সাগরদ্বীপ পাঁচ নম্বরেই বাড়ি অঞ্জুমান বিবির। ছেলে, ছেলের বউ নাতি নিয়ে সংসার। অঞ্জুমান বিবি গঙ্গাসাগর মেলায় সাফাই কর্মীর কাজ করে। আগে এই গ্রামে কুড়ি তিরিশটির মতন পরিবার ছিল। তার মধ্যে কয়েকটি পরিবার আবাস যোজনা প্রকল্পে ঘর পেয়ে অন্য জায়গায় সরে গিয়েছে। বাকিরা গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘর করেছে। অঞ্জুমান বিবির মতন যাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় তারাই শুধু রয়ে গিয়েছে গ্রামটিতে। সকলেরই ঘর হোগলা পাতার।
দুর্যোগ আসে-যায়, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই যেন শেষ হতে চায়না। প্রকৃতির রোষে বার বার ‘উদ্বাস্তু’ হওয়াই যেন ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সাগরদ্বীপের মানুষের। কখনও আমফান, কখনও বা ইয়াস— ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে বার বার ঘরহারা হয়েছেন। সবারই আক্ষেপ, প্রকৃতিই সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে তাঁদের। গঙ্গাসাগর মেলা এলে এই সাগরদ্বীপ বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। পুরো দেশের অনেক মানুষই চলে আসেন সাগর স্নানে। তা না হলে বছরের বাকি সময় কাটে নির্জনতায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি নদী ভাঙন এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
"কুম্ভ মেলার পরে সব থেকে বড় মেলা গঙ্গাসাগর। মকর সংক্রান্তির ওই কয়েকটা দিন মাত্র খবরের কাগজ, টিভিতে চর্চা হয় এই গ্রাম নিয়ে। তা না হলে কিভাবে দিন কাটে সকলের তার খোঁজ কেউ রাখে না। সব রকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত বেশীরভাগ মানুষ", বলছিলেন সাগরদ্বীপ পঞ্চবটি গ্রামের বছর পঁচিশের যুবক শেখ আনিসুল। বছরের অর্ধেক সময় পাঞ্জাবে সেলাইয়ের কাজ করতে যায়। আনিসুলের অভিযোগ গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে সারা দেশে এত হইচই সেখানে এলাকার মানুষরই কোন উন্নতি নেই। নেই কোন কর্মসংস্থান। একশ দিনের যে কাজ সেই কাজের টাকাও আটকে রেখেছে। এলাকার যুবকদের রোজগারের জন্যে বাইরের রাজ্যে চলে যেতে হয়। আর এখন যেভাবে সমুদ্র এগিয়ে আসছে তাতে সাগরদ্বীপ এমনিতেই জলের তলায় চলে যাবে!
ইতিহাস অনুযায়ী আনুমানিক ৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে রানি সত্যভামা প্রথম কপিলমুনির মন্দির তৈরি করেন। বহুদিন আগে সেই মন্দির সমুদ্র গর্ভে চলে গেছে। এভাবেই আরও ৬টি মন্দির চলে গিয়েছে সাগরের জলে। বর্তমান মন্দিরটি তৈরি হয় ১৯৭০ সালে। এই মন্দিরটিকেও রক্ষা করা যাবে তো? সাগর মাস্টার প্ল্যান কবে বাস্তবায়িত হবে? ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে কপিলমুনির মন্দিরের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে অনেক প্রশ্নই। গঙ্গাসাগরের পুণ্যস্নান নিয়ে এতো মাতামাতি দেশজুড়ে। সেই গঙ্গাসাগরই অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে। এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বহু মানুষ। যারা রয়েছেন তাঁদের অভিযোগ, এলাকার কোন মানুষ সরকারী সুযোগ সুবিধা পায় না। লাখো লাখো মানুষ এই গঙ্গাসাগরে এসে জড়ো হয়। কত কত টাকা খরচ করে সরকার। এতে গ্রামের তেমন কোনও উন্নয়ন হয় না। সাগর পঞ্চায়েত প্রধান হরিপদ মন্ডলের বক্তব্য," অনেকের জমির কাগজ পত্র নিয়ে গণ্ডগোল রয়েছে তার কারণে আবাস যোজনায় ঘর দেওয়া যায়নি। এছাড়াও আরও অন্যান্য সরকারি যেসব প্রকল্প রয়েছে তা তো দেওয়া হচ্ছে। প্রতি বছর ঝড়ে যে সব ক্ষয়ক্ষতি হয় তাতে সবরকম সাহায্যেও করা হয়। সমুদ্রের ভাঙ্গন আটকাতে সব রকম কাজ হচ্ছে।"
সমুদ্র একটু একটু করে প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসছে। সাগর দ্বীপের আয়তনও ক্রমশ কমছে। এই বিষয়ে পরিবেশবিদ ডাঃ সাথী নন্দী চক্রবর্তী বলছেন, "উষ্ণায়ন না কমালে বিপদ অশেষ, এ কথা এখন বোধগম্য। গ্রিন হাউস এফেক্ট বলে একটা কথা আছে। যখন বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায় তখন পরিবেশের ভারসম্য নষ্ট হয়। সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমুদ্র নিজের গতিপথ পরিবর্তন করে। এখন গঙ্গাসাগরে যে স্থলভাগ রয়েছে আগামীতে সেইসব স্থলভাগ জলের নীচে চলে যাবে।" ফলে বর্তমান কপিলমুনির মন্দিরের ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, মন্দিরের সামনে সমুদ্রতটের পাড় ভাঙার সমস্যা দীর্ঘদিনের। ভাঙনের জেরে গঙ্গাসাগর মেলার মাঠের আয়তন ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর গঙ্গাসাগরে ১০০-২০০ ফুট এলাকা সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। গঙ্গাসাগরের সমুদ্রতট বরাবর এক নম্বর রাস্তা থেকে পাঁচ নম্বর রাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকায় সারিবদ্ধ ভাবে নারকেল গাছ পুঁতেছিল প্রশাসন। সম্প্রতি ভাঙনের কবলে পড়ে নারকেল গাছগুলি সমুদ্রে তলিয়ে গিয়েছে। সাগর পঞ্চায়েতের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা বাসুদেব মান্না, গঙ্গাসাগর মেলায় দিন মজুরের কাজ করেন, তিনি বলেন "সাগর পারে ঘর হারানোর চিন্তা তো লেগেই থাকে। দুর্যোগে ভিটেমাটি হারানোর যন্ত্রণা এখন সবই সহ্য হয়ে গিয়েছে। এক বছর আগেও কারো যেখানে ঘর বা দোকান ছিল সেখানে এখন সমুদ্র সেই জায়গা গিলে খেয়ছে। সাগরদ্বীপের সকলেই জানে, আজ না হয় কাল ঘর ছাড়তে হবে। দুশ্চিন্তা করেও লাভ নেই। কারণ বাড়ি ফিরে দেখব, কারো ঘর ভেঙেছে কারও বা জায়গা চলে গিয়েছে জলের তলায়। গঙ্গাসাগরে যারা ডুব দিয়ে পুণ্য লাভ করে সেই সাগরই হয়তো পাপ ফিরিয়ে দেয় সমুদ্রতটে। দুর্যোগের জন্য বছরে তিন-চার বার আশ্রয় শিবিরে চলে আসতে হয়। এ ভোগান্তিতে সরকারকে দোষ দিয়ে কী লাভ! প্রকৃতিই তো সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে। আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই জানে কজন?’’