মাসখানেক আগেও এখানে ছিলেন শতাধিক রোহিঙ্গা। এখন প্রায় জনশূন্য বারুইপুরের হরদহ গ্রামে রোহিঙ্গাদের একমাত্র শিবির। দিন কয়েক আগে থেকেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে মোটামুটি সকলেই শিবির ছাড়তে শুরু করেছিলেন। শেষ যে পরিবারটি বাকি ছিলেন, তারাও শুক্রবার ভোর রাতে চলে গিয়েছেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুরের কাছে জনা তিরিশ রোহিঙ্গাদের নিয়ে এই আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল তিনশো-র কাছাকাছি। এখন তাঁদের মধ্যে একজনও এই আশ্রয় শিবিরে নেই।
প্রশ্ন উঠছে এখানেই, কোথায় গিয়েছেন তাঁরা? হরদহ গ্রামের স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, বেশ কিছু দিন ধরে এলাকায় অনেক অপরিচিত মানুষের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল। অনেক সময়ই গ্রামে পুলিশ ঢুকে পড়ত। এতে রোহিঙ্গাদের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এছাড়া মাস ছয়েক ধরে রোহিঙ্গা পুরুষরা বাড়িতেই বেকার বসে। স্থানীয় কয়েকজনের সাহায্যে দু একজন কাজ পেলেও বাকিদের তেমন কোনও আর্থিক উপার্জন ছিল না।
হরদহ গ্রামে টিনের বাড়ি বানিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবারগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিলেন এলাকায় সমাজসেবী নামে পরিচিত হোসেন গাজী। তাঁর কথায়, "আসামে এনআরসি শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সবাইকে মায়ানমার ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে সাহায্যে সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। ইদানীং পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে সকলে ভয় পেয়ে যায়। তারপর থেকে একে একে সকলে শিবির ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে।" গাজী সাহাবের এই কথা কতটা সঠিক তা অবশ্য যাচাই করবার উপায় নেই আপাতত।
ঘুটিয়ারি শরিফের কাছে লুকিয়ে থাকা এক রোহিঙ্গা পরিবারের দাবী, গাজী সাহেব তাঁদের দিল্লি থেকে থাকা খাওয়ার এবং কাজ দেওয়ার নাম করে এই শিবিরে নিয়ে এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। কিন্তু এখনও কাজের দিক থেকে কিছুই হয়নি। গ্রামের লোকজনই চাল-ডাল বা জামাকাপড় দিয়ে সাহায্য করেছে। এতে অনেকের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ছিল। তার ওপর যে জমির ওপর ক্যাম্প করা হয়েছে তা গাজী সাহেবের সাত ভাইয়ের নামে, যার ফলে ক্যাম্প করা নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। এর ফলে প্রায়ই পুলিশ আসত। যার কারণে শিবিরের সকলে ভয়ে জায়গা ছাড়তে শুরু করেন।
রোহিঙ্গা শিবিরের গ্রামের রাস্তার মাথার সামনে এক দোকানীর কথায়, "হরিয়ানা থেকে দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে লরি ভর্তি লোক ফ্রিজ, আলমারি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু যত দিন গেছে, টাকা পয়সার জন্যে সব বিক্রি করে দিয়েছে। আমরা নিজেরাই কেউ চাল রুটি বা অন্যান্য খাবার দিয়ে ওদের সাহায্যে করেছিলাম। ওদের বাচ্চারা আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গেই খেলত।" শিবির থেকে একটু দূরে হরদহ মসজিদের কাছে ১৮ জনের একটি রোহিঙ্গা পরিবার এখনও রয়ে গিয়েছে। পরিবারেরই সদস্যা সুমাইয়া বিবির কথায়, তাঁরা মায়ানমার থেকে প্রথমে দিল্লী গিয়েছিলেন, এরপর হরিয়ানাতে বেশ কিছুদিন থাকার পর বাংলায় চলে আসেন। হরিয়ানাতে তিনি বাচ্চাদের ইংরেজি পড়িয়ে আর কাপড় সেলাই করে সংসার খরচ চালাতেন।
তাঁর স্বামী ওখানে এক কারখানায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর বড় ভাশুরের পরিবারও একই কাজ করে সংসার চালাতেন। বাংলায় আসার পর থেকে সমস্যায় পড়তে হল। এখানে এসে চিকিৎসার অভাবে প্রথমে মারা গেল তাঁর আট মাসের সন্তান। তারপর এক মাস যাবত শিবিরে ঝামেলা শুরু হওয়ার পর থেকে এদিক থেকে ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। হাতে টাকা পয়সা কিছু নেই। গ্রামের লোকজনই চাঁদা তুলে তাঁদের বাড়ি ভাড়া করে এখানে রেখেছেন। এই জায়গা ছেড়ে দিলে "মরে যাওয়া" ছাড়া উপায় নেই।
হরদহ গ্রামের বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে যতটা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন, ঠিক ততটাই নেতিবাচক সাতবিবি, ঘুটিয়ারি শরিফ, ফড়িংপোতা এলাকার মানুষজন। এখানকার একাংশের অভিযোগ, রোহিঙ্গা শিবির থেকে লোকজন বেরিয়ে এসে নিজেদের "পরিচয় গোপন করে" স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছেন। কেউ কেউ দিল্লী, হরিয়ানা, জম্মু কাশ্মীর ফিরে গেলেও অনেকে এমন আছেন যাঁরা আশপাশের এলাকাতেই লুকিয়ে পড়েছেন।
যদিও হরদহ গ্রামের মানুষজন এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। যতদিন এই রোহিঙ্গা শিবির ছিল, তাতে কারও কোনও অসুবিধা হয়নি। সবাই মিলেমিশেই ছিলেন, তাঁদের ব্যবহারও ছিল অমায়িক। প্রসঙ্গত, রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে বাংলা, এই আশ্বাসে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো হাড়দহ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু কেন এমন হল, কিসের কারণে রাতারাতি হঠাৎ শিবির ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন তাঁরা? চিহ্নিতকরণের ভয়, নাকি রাজনৈতিক কোনও চাপ? এই নিয়ে এক বিরাট সংশয় থেকে যাচ্ছে সকলের মনে।