কুকুরের সঙ্গে মানুষের সখ্যতার কথা কারুরই অজানা নয়। তবে অনেকেই আছেন যারা পথ কুকুরদের থেকে নিজেদের দূরে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন। তবে চন্দননগরের সঞ্চিতা কিন্তু এমন ধারণার ঘোর বিরোধী। পথ কুকুরদের সঙ্গে ভাইফোঁটা সেলিব্রেশন থেকে শুরু করে পঙ্গু পথ কুকুরদের জন্য বিশেষ হুইল কার্টের ব্যবস্থ করা, তার এই অভিনব উদ্যোগ ইতিমধ্যেই প্রশংসা কুড়িয়েছে অসংখ্য মানুষের।
অনেকেই হয়তো জানেন না বুদ্ধিমত্তায় জার্মান শেফার্ড, ল্যাব্রাডর, বেলজিন ম্যালিনোইস ও গ্রেট স্যুইশ মাউন্টেন ডগের পাশাপাশি পথ কুকুর বা চলতি কথায় দেশি কুকুর কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। সম্প্রতি দেশি কুকুরদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিষয়েও ভাবনা-চিন্তা চালু হয়েছে। তার পিছনেও রয়েছে বেশ কিছু কারণ।
প্রথমত বিদেশি কুকুরদের থেকে দেশি কুকুরদের পিছনে খরচ একদিকে যেমন কম লাগবে তেমনই সব ধরণের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে একেবারে ওস্তাদ দেশি কুকুর। ফলে জঙ্গিদের খুঁজে বার করতে অথবা বিস্ফোরক উদ্ধারে দেশি কুকুরের জুড়ি মেলা ভার। এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে। যে কাজ করতে জার্মান শেফার্ড বা ল্যাব্রাডরের ৯০ সেকেন্ড সময় লাগে, দেশি কুকুর ৪০ সেকেন্ডের কম সময়েই তা করে ফেলতে ফেলতে সক্ষম।
এই পথ কুকুরদের নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর ধরে কাজ করে চলেছেন হুগলির চন্দননগরের বাসিন্দা সঞ্চিতা পাল। পথ কুকুরদের সঙ্গে ভাইফোঁটা সেলিব্রেশন হোক অথবা দুর্ঘটনায় পা বাদ হয়ে যাওয়া কোন পথ কুকুরের শ্রুশুষা কোন কিছুতেই পিছিয়ে নেই সঞ্চিতা পাল। ইতিমধ্যেই পথ কুকুরদের প্রতি তার এই ভালবাসার কথা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকেই জানেন। রীতিমত প্রতিদিন সকালে সকাল রুটিন করে সংলগ্ন অঞ্চলের কমবেশি ২০০-এর কাছাকাছি পথ কুকুররে খাওয়ানো থেকে শুরু করে তাদের শারীরিক পরীক্ষা, অসুস্থ পথ কুকুরদের সেবা-শ্রুশুষা অথবা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে কিন্তু বেঁচে রয়েছে এমন পথ কুকুরদের পাশে দাঁড়িয়ে রীতিমত নজির গড়েছেন তিনি।
সম্প্রতি তার এক অভিনব উদ্যোগ নজর কাড়ে সকলের। অপারেশনের পর পা বাদ পড়া পথ-কুকুরদের জন্য বিশেষ এক হুইল কার্টের ব্যবস্থা করে তাদেরকে আবার স্বাভাবিক জীবন উপহার দিয়েছেন তিনি। সঞ্চিতার এই অভিনব প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাচ্ছে নেটিজেনরা । সঞ্চিতার এই মহান কাজে সঙ্গ দিয়েছেন স্বামী পিকাসো।
নিজের এই উদ্যোগ সম্পর্কে সঞ্চিতা বলেন, “ছোট বেলা থেকে পশু পাখিদের প্রতি এক অদম্য ভালবাসা গড়ে ওঠে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভালবাসা বেড়ে যায় বহুগুণে। বিয়ের আগে চন্দননগর ও সংলগ্ন অঞ্চলে পথ কুকুরদের জন্য কাজ করেছি। বিয়ের পর দুর্গাপুরে গিয়েও একই কাজ করেছি, ফের নিজের এলাকায় এসে আবারও পথ কুকুরদের নিয়ে কাজ শুরু করা। একটু অন্যরকম ভাবে বিষয়টা ভাবতে শুরু করেছিলাম। শুধু পথ কুকুরদের খাওয়ানো নয়, সেই সঙ্গে অসুস্থ অথবা পঙ্গু পথ কুকুরদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করাও আমার লক্ষ্যের মধ্যে ছিল।
তিনি বলেন, ‘এখন প্রতিদিন ২০০ পথ কুকুরদের খাওয়ানো থেকে শুরু করে তাদের চিকিৎসা সব দায়িত্বটাই আমার কাঁধে। সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে এই কাজে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষকে মানুষকে পাশে পেয়েছি। অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে স্বামীর কাছ থেকে সব সময়ই এ কাজে সহযোগিতা পেয়েছি’।
পঙ্গু পথ-কুকুরদের চলার সুবিধার জন্য বিশেষ হুইল কার্ট সম্পর্কে সঞ্চিতা বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়াতেই বিদেশের একটি ওয়েবসাইটে চাকা লাগানো কুকুরের পায়ের সম্বন্ধে জানতে পারি। তারপর থেকে শুরু হয় আমার খোঁজার পালা। অবশেষে ইউটিউব ঘেঁটে জানতে পারি রাজস্থানের একটি সংস্থা এমন হুইল কার্ট প্রস্তুত করে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সোনামণি নামের এক পঙ্গু পথ-কুকুরের জন্য প্রথম এই চাকা লাগানো চেয়ার অর্ডার করি। ওরা একেবারে মাপ করে বানিয়ে পাঠায়। তার পর থেকে পঙ্গু অথবা অপারেশনে পা বাদ গিয়েছে এমন পথ-কুকুরদের জন্য প্রয়োজনে বিশেষ এই হুইল কার্ট অর্ডার করি’।
সঞ্চিতা জানিয়েছেন, পথ কুকুরদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু সামাজিক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। সহ্য করতে হয়েছে নানান বঞ্চনাও। তাও তিনি নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে কাজ করে চলেছে পথ কুকুরদের নিয়ে। ভবিষ্যতের ইচ্ছা প্রসঙ্গে সঞ্চিতা বলেন, ‘ ইচ্ছা রয়েছে পথ কুকুরদের জন্য এক হাসপাতাল গড়ার, যেখানে বিনামূল্যে পথ কুকুরদের চিকিৎসা সেই সঙ্গে আশ্রয়ের সুযোগও মিলবে। এজন্য জমি দেখার কাজও শুরু করেছি। অনেক মানুষই আমার এই কাজে উৎসাহ জুগিয়েছেন’। পাশাপাশি তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন জানান যে সব মানুষ বাড়িতে বিদেশি কুকুর পুষছেন তার সঙ্গে যাতে তারা একটা বা দুটো পথ কুকুরের দায়িত্ব নেন।