ইছামতী নদীতে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের ঐতিহ্যের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে গেল। গত বছরের নিরাপত্তার কড়াকড়ি এবার আরও আঁটসাঁট হয়েছে। নদীবক্ষে একে অপরকে আড়াল করেই চলল নিরঞ্জনের পালা। নেই সেই আবেগ, নেই কোনও উৎসাহ। যদিও এবারও বহু মানুষ দশমীর দিন হাজির হয়েছিলেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ইছামতী নদীর পাড়ে, শেষমেশ হতাশ হলেন দুই পাড়ের মানুষ ও পর্যটকরা।
সীমান্তবর্তী এই শহরে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের ধুমধাম কয়েক যুগ ধরে চলছে। দশমীর দিন দুই দেশের মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতেন ইছামতী নদীর বুকে। ওপারে বাংলাদেশ, এপারে ভারত। দুই দেশের মানুষ দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন। তারপর নিজ নিজ দেশের পতাকা উড়িয়ে নৌকোয় চড়ে প্রতিমা বিসর্জন চলত। এদেশের নৌকোতে ওদেশের মানুষ, এপার-ওপারের মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতেন। আনন্দে মেতে উঠতো পুরো ইছামতী। বিজয়া দশমীর কুশল বিনিময় হতো। চলত মিষ্টিমুখ।
ইছামতি নদীতে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের ঐতিহ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে গেল। গত বছরের নিরাপত্তার কড়াকড়ি এবার আরও আঁটসাঁট হয়েছে। আর দেখা যাবে না চিরপরিচিত ভারত-বাংলাদেশ মিলনের দৃশ্য, হতাশ দু'দেশের মানুষ #DurgaPuja #DurgaPujo pic.twitter.com/XJJ0tISd9n
— IE Bangla (@ieBangla) October 8, 2019
তখন ছিল না নিরাপত্তার কোনও বহর। বরং অনেকটাই ছাড় ছিল। আবার বিসর্জনের পর দুই দেশের মানুষ নিজের নিজের ঘরে ফিরে যেতেন। এটাই ছিল পরম্পরা। এটাই ছিল দীর্ঘকালের রীতি। এই একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষজন। শুধু তাই নয়, দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা এসে হাজির হতেন বিসর্জনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে। অসাধারণ সেই প্রেক্ষাপট। কিন্তু সেসব এখন স্বপ্ন। এদিনও অনেক পর্যটক হাজির হয়েছিলেন। ফিরলেন হতাশা নিয়ে।
দেখুন ছবিতে: ইছামতীতে বিদায় বেলায় মা, দুই বাংলার মিলন আজ অতীত, দেখুন ফোটো গ্যালারী
মঙ্গলবার কলকাতা থেকে এসেছিলেন দুর্গেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক আশা নিয়ে ইছামতীর নদীর পাড়ে হাজির হন। কিন্তু সেই চিরাচরিত দৃশ্য অধরা থেকে যায়। আক্ষেপ তাঁর গলায়। বলেন, "হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম সেই বিসর্জনের সাক্ষী হতে। আমি শুনেছি দুই দেশের মানুষ দুর্গা বিসর্জনের সময় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এখানে। দুই বাংলা যেন এক বাংলার রূপ নেয় এদিন। কিন্তু সাক্ষী থাকতে পারলাম না। নদীর মাঝে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বোট দুভাগ করে দিয়েছে। আর তো কখনও বোধহয় সম্ভব হবে না।"
অতীতে বিসর্জনের সাক্ষী বহু মানুষ এদিনও হাজির হয়েছিলেন। দেখা যায়, ইছামতী নদীর মাঝে বিএসএফ এবং বিডিআর, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বোট পাহারায়। কড়া নজর বিসর্জনের দিকে। বাংলাদেশের প্রতিমা ওপারেই নিরঞ্জন চলছে, এপারে চলছে ভারতের প্রতিমা বিসর্জন। দূর থেকে কেউ কেউ হাত নাড়ছেন। এপার-ওপার থেকে একে অপরকে হাঁক দিয়ে বলছেন, "কী রে বাদল, কী খবর?" এপারের ডাক ওপারে কোনোরকমে শোনা যায়, "হ্যাঁ, ভালো আছি। তোমারা ভালো আছ তো সুরেশ?" কিন্তু সেই আলিঙ্গন, সেই দশমীর শুভেচ্ছা, কুশল বিনিময়, সবই আজ ইতিহাস। এক অজানা জগৎ হয়ে উঠেছে ইছামতী।
গতবছর নিরাপত্তার কড়াকড়ি শুরু হয়েছিল। এ বছর একেবারেই আঁটসাঁট তার ঘেরাটোপ। মাছিও যেন না গলে। মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। কড়া নির্দেশ, বিসর্জনের মাধ্যমে কোনোরকম ভাবেই যেন অনুপ্রবেশ না ঘটে। আজ সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল ইচ্ছামতী নদীর বিসর্জনের ইতিহাস। ঐতিহ্য আজ মলিন, ধূসর।