স্টেশনে থাকা ভিখারিদের দেখলেই সাধারণত সকলে পাশ কাটিয়ে চলে যান। কিন্তু নদিয়ার মাজদিয়ার পাপিয়া কর পাশ কাটিয়ে যাওয়া দূরস্ত, ভিখারিদের নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দেন। ১৪ বছর ধরে নিজের হাতে নীরবে করে চলেছে এই বিশাল কর্মকাণ্ড। আর সেই কর্মকাণ্ডই সাধারণের সামনে তুলে ধরতে বাগুইআটির অশ্বিনীনগর বন্ধুমহল ক্লাবের এবারের পুজোর চমক ‘ভাগাড়ের মা’। পাপিয়াদেবীর এই অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে কুর্নিশ জানাতেই পাপিয়া দেবীর কর্মকাণ্ডকে নিয়ে আস্ত একটা পুজো মণ্ডপের থিম! এবারের দুর্গাপুজোয় বাগুইআটি অশ্বিনীনগর বন্ধুমহল ক্লাবের থিমে উঠে আসতে চলেছে পাপিয়াদেবীর এই কর্মকাণ্ড।
পুজোর থিমের প্রশ্নে অশ্বিনীনগর বন্ধুমহল ক্লাবের দুর্গাপুজোর মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর স্বরূপ নাগ বলেন, “থিমের পুজোর মাধ্যমে সামাজিক বার্তা দেওয়াই আমাদের ক্লাবের বিশেষত্ব! এই বছর আমাদের ক্লাবের দুর্গাপুজার থিম হিসাবে উঠে এসেছে ‘ভাগাড়ের মা’!” অভিনব এই থিম জুড়েই থাকছেন পাপিয়া কর। ১৪ বছর ধরে পাপিয়াদেবীর কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরা হবে সাধারণের সামনে। সেই সঙ্গে প্যান্ডেলে থাকছে পাপিয়াদেবীর হাতের তৈরি দুর্গাপ্রতিমা”।
কেমন ভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে সেই মণ্ডপ? পুজো প্যান্ডেলে থাকবে আস্ত একটি রেল স্টেশন ! থাকবে এক প্লাটফর্ম থেকে অন্য প্লাটফর্মে যাওয়ার জন্য ওভার ব্রিজ ৷ এছাড়াও গড়ে তোলা হবে টিকিট কাউন্টার, চায়ের দোকান, বুক স্টল ৷ হঠাৎ দেখলে এই মণ্ডপকে সত্যিকারের রেল স্টেশন বলে ভুল হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয় ! আর সেখানেই পাপিয়াদেবীর কর্মকাণ্ডকে ফুটিয়ে তোলা হবে। থাকছে কাঠের তৈরি বিভিন্ন মূর্তি, তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাপিয়া দেবীর সাধের ‘ভাই’ গোবিন্দকেও। থাকছে অন্নপূর্নার সরাইঘরও।
হঠাৎ কেন ‘ভাগাড়ের মা’ নামকরণ? তা নিয়ে পুজো উদ্যোক্তাদের দাবি, “আমাদের নানা অব্যবহৃত জিনিস পত্র আমরা ভাগাড়ে ফেলে দিই, ঠিক তেমনই সমাজের একটা শ্রেণি দরিদ্র অসহায় মানুষের সঙ্গে তেমনই আচরণ করেন। তাদের সমাজের সব কিছু থেকে ব্রাত্য করা হয়। আর পাপিয়া দেবী সেই মানুষগুলোর জন্য ১৪ বছর ধরে প্রাণপাত করে চলেছেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই ‘ভাগাড়ের মা! তার এই সকল প্রয়াসকে কুর্নিশ জানাতেই এবারে আমাদের এই থিম”।
আরও পড়ুন: < কলকাতাকে টেক্কা জেলার পুজোর,৭০ ফুটের মাতৃপ্রতিমা ঘিরে চমকের ছড়াছড়ি! >
যাকে নিয়েই গড়ে উঠেছে আস্ত একটা পুজোর থিম সেই পাপিয়া করের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এক কথায় আমি অভিভূত! এত বড় সম্মান পাব আমি কোনওদিন কল্পনা করি, বাঙালির প্রাণের পুজোয় কোনও একটি ক্লাবের থিম জুড়ে শুধু আমি, এটা আমার কাছে একটা স্বপ্নের মতো, আমি বাগুইআটি অশ্বিনীনগর বন্ধুমহল ক্লাবের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ’!
ফেলে দেওয়া সামগ্রী দিয়েই ইতিমধ্যেই গড়েছেন দুর্গাপ্রতিমা, বিক্রির টাকায় অসহায় মানুষের পাশে ‘ভাগাড়ের মা’ পাপিয়া! প্রতিমা বিক্রির টাকায় পুজো উপলক্ষে ১৫০ অনাথ অসহায় মানুষের হাতে তিনি তুলে দিয়েছে নতুন জামাকাপড় থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তুলে দিয়েছেন খাবার। ইতিমধ্যেই পাপিয়াদেবীর হাতের তৈরি দুর্গা পৌঁছে গিয়েছে অশ্বিনীনগর বন্ধুমহল ক্লাবের দুর্গাপুজোয়।
পাপিয়াদেবি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে জানান, “এবারের দুর্গা মূর্তি ১১ বছরে পড়ল। এবারের থিম ‘শিক্ষা’। মূর্তি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়নি কোন বাঁশ, বিচুলি, মাটির ব্যাবহার। পুরোটাই কাগজ দিয়ে করা। আর যেহেতু থিম ‘শিক্ষা’, তাই সমস্ত কিছু শিক্ষা সামগ্রী ( রাবার,পেন্সিল, সেলেট,মোমরং,রং পেন্সিল) দিয়ে তৈরি করা। তৈরি করতে সময় লেগেছে ১০ মাস। ১৬ হাজার ব্যায়ে এই প্রতিমার ওজন,৬ কেজি এবং উচ্চতা ৬ ফুট”।
তিনি বলেন, “এই থিমের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছি পৃথিবীতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আর সন্তান বড় হয়ে যাই হোক, ডাক্তার, গায়ক, শিক্ষক! প্রতিটি সন্তানের প্রথম শিক্ষক হন তাঁর মা। তাই মা শিক্ষিত হলে সন্তান ও সুন্দর ভাবে গড়ে ওঠে। মায়ের শিক্ষা সবার আগে দরকার”।
পাপিয়াদেবি আরও জানান, “মহিষকে এখানে অসুর হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে । এখানে অসুর হল অশিক্ষা,কুসংস্কার। তাই মায়ের হাতে কলম ‘কুসংস্কার’ অসুর’কে বধ করছে। এখানে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি শিক্ষা দিয়েই কুসংস্কার কে বধ করা সম্ভব”। পাপিয়ার কথায়, “সমাজের এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে থাকার থেকে বড় শান্তি আর কিছুতেই নেই”। চলতি বছর নিজের হাতে দুটো মূর্তি গড়েছেন পাপিয়াদেবি। কাঠের ফুলকি দিয়ে তৈরি করা অপর একটি মূর্তি যাবে রানাঘাট পাইকপাড়া ব্রতী সংঘ ক্লাবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রাতের রাতে রানাঘাট স্টেশনের দুঃস্থ মানুষগুলোর মুখে বিয়েবাড়ির আলাদা করে রাখা মুখে তুলে দিয়েই সংবাদ মাধ্যমের নজরে আসেন মাজদিয়ার পাপিয়া কর। একের পর এক নানান সমাজসেবা মূলক কাজে এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে পাপিয়াদেবীকে। অন্নপূর্ণার সরাইঘর থেকে কলকাতার রাজপথে দুঃস্থ শিশুদের প্রতি রবিবার নিয়ম করে ক্লাসও করান পাপিয়া। কলকাতার পাশাপাশি মাঝদিয়াতেও পথশিশুদের জন্য বিশেষ স্কুল রয়েছে পাপিয়াদেবী। পাপিয়ার কথায়, “সমাজের এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে থাকার থেকে বড় শান্তি আর কিছুতেই নেই”।